রাষ্ট্রপতিরসচিবালয়

ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ কর্তৃক ৭৩ তম সাধারণতন্ত্র দিবসের প্রাক-সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের বাংলা ভাষান্তর

Posted On: 25 JAN 2022 7:27PM by PIB Kolkata

নয়াদিল্লি ২৫ শে জানুয়ারি


প্রিয় দেশবাসীগণ, নমস্কার!

১.  ৭৩তম সাধারণতন্ত্র দিবসের পূর্বসন্ধ্যায়, দেশ ও বিদেশে বসবাসকারী সমস্ত ভারতবাসীকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা! আমাদের সকলকে এক সূত্রে বেঁধে রাখা ভারতীয়ত্বের গৌরবের এই উৎসব। ১৯৫০ সালে আজকের দিনেই আমরা সকলের এই গৌরবময় পরিচয়কে আনুষ্ঠানিক স্বরূপে পেয়েছিলাম। সেদিন, ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আর আমরা, ভারতের জনগণ একটি এমন সংবিধান প্রণয়ন করেছি যা আমাদের সামগ্রিক চেতনার জীবন্ত দস্তাবেজ।

আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সফল গণতন্ত্র গোটা বিশ্বে প্রশংসিত। প্রত্যেক বছর সাধারণতন্ত্র দিবসের এই দিনে আমরা আমাদের গতিশীল গণতন্ত্র তথা জাতীয় একতা ভাবনার উৎসব পালন করি। মহামারীর কারণে এ বছর উৎসবে ধুমধাম যত কমই হোক না কেন, আমাদের ভাবনা সবসময়ের মতোই সমান শক্তিশালী।     

২.  সাধারণতন্ত্র দিবসের এই দিনটি সেই মহানায়কদের স্মরণ করার সুযোগ এনে দেয় যাঁরা স্বরাজের স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়িত করতে অতুলনীয় সাহসের পরিচয় দিয়েছেন আর স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে দেশবাসীর মনে লড়াইয়ের উৎসাহ যুগিয়েছেন। দু’দিন আগে, ২৩ জানুয়ারি তারিখে আমরা সমস্ত দেশবাসী, ‘জয় হিন্দ’ এর শ্লোগান তোলা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর পবিত্র স্মৃতিকে স্মরণ করেছি। স্বাধীনতার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা আর ভারতকে গৌরবান্বিত করে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমাদের সকলের জন্য প্রেরণার উৎস। 

৩. আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের সভায় সেই সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষীরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এই মনীষীরা আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নায়ক ছিলেন। দীর্ঘ অন্তরালের পর, ভারতের জাতীয় চেতনার পুনর্জাগরণ চলছিল। এভাবে, সেই অসাধারণ নারী ও পুরুষরা একটি নতুন জাগৃতির অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করছিলেন। তাঁরা সংবিধানের খসড়ার প্রতিটি অনুচ্ছেদ, প্রত্যেক বাক্য এবং শব্দে, সাধারণ জনগণের স্বার্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সেই আলাপ-আলোচনা প্রায় তিনবছর ধরে চলেছে। অবশেষে, ডক্টর বাবাসাহেব আম্বেদকর খসড়া সমিতির অধ্যক্ষ হিসেবে, সংবিধানের প্রাতিষ্ঠানিক স্বরূপ প্রদান করেন, আর সেটাই আমাদের মৌলিক গ্রন্থে পরিণত হয়।

৪. আমাদের সংবিধানের আয়তন অনেক বড় কারণ এতে রাজ্যগুলির কাজকর্মের পদ্ধতির বিবরণও রয়েছে। সংবিধানের সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনাতে গণতন্ত্র, ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য এবং সৌভ্রাতৃত্বের দিক নির্দেশকারী সিদ্ধান্ত, সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা আছে| এই আদর্শগুলি সেই ভিত্তিকে নির্মাণ করেছে, যে ভিত্তির উপর আমাদের মহান গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে| এই জীবনের মূল্যবোধে আমাদের সম্মিলিত ঐতিহ্যও পরিলক্ষিত হয়|

৫. জীবনের এই মূল্যবোধকে আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও মৌলিক কর্তব্য হিসেবে প্রাথমিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে| অধিকার আর কর্তব্য একই মুদ্রার দুই পিঠ| সংবিধানে উল্লেখিত মৌলিক কর্তব্যগুলোকে পালন করার মধ্য দিয়ে মৌলিক অধিকারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়| দেশের সেবা করার মৌলিক কর্তব্য পালন দেশবাসী পালন করেন।  আমাদের কোটি কোটি দেশবাসী স্বচ্ছতা অভিযান থেকে শুরু করে কোভিড টিকাকরণ অভিযানকে জন-আন্দোলনের রূপ দিয়েছেন| এই ধরনের অভিযানের সাফল্যের কৃতিত্ব আমাদের কর্তব্য-পরায়ণ নাগরিকদের| আমার বিশ্বাস যে, আমাদের দেশবাসী এই ধরনের কর্তব্য-নিষ্ঠার সঙ্গে দেশহিতের অভিযানের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শক্তিশালী করতে থাকবেন|

প্রিয় দেশবাসী,

৬. ভারতের সংবিধান ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত, গৃহীত ও নিবেদিত হয়| সেজন্য সেই দিনকে আমরা সংবিধান দিবস হিসেবে উদযাপন করি| এর দুই মাস পরে ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি আমাদের সংবিধান সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়| এটা ১৯৩০ সালের সেই দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে করা হয়েছে, যেদিন ভারতবাসী সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করার সংকল্প গ্রহণ করেছিল| ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত, প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারিকে ‘পূর্ণ স্বরাজ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হ’ত| তাই এটা স্থির করা হয় যে, সেই তারিখেই সংবিধানকে সম্পূর্ণ কার্যকর করা হবে|

৭. মহাত্মা গান্ধী ১৯৩০ সালে দেশবাসীকে ‘পূর্ণ স্বরাজ দিবস’ উদযাপনের পদ্ধতি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন| তিনি বলেছিলেন:
“...আমরা যেহেতু আমাদের লক্ষ্যকে অহিংসা ও সত্যের উপর ভিত্তি করে পেতে চাই, আর সেই কাজ আমরা শুধুমাত্র আত্ম-শুদ্ধির মাধ্যমেই করতে পারি| সেজন্য আমাদেরকে সেদিন সম্পূর্ণ সময় যতটুকু সম্ভব কোনো না কোনো গঠনমূলক কাজ করে কাটানো উচিত|”

৮. যথা সম্ভব গঠনমূলক কাজ করার জন্য গান্ধীজির এই উপদেশ সর্বদাই প্রাসঙ্গিক থাকবে| তাঁর ইচ্ছা অনুসারে গণতন্ত্র দিবসের উৎসব উদযাপনের দিন এবং তার পরেও আমাদের সবার চিন্তাধারা ও কাজে সৃজনশীলতা বজায় রাখতে হবে| গান্ধীজি চাইতেন যে, আমরা যেন আমাদের অন্তরে আত্ম-নিরীক্ষণ করে দেখি এবং আরও ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি| তারপর বাইরেও দেখি, মানুষের সঙ্গে সহযোগিতা করি এবং এক উন্নত ভারত ও উন্নত বিশ্বের নির্মাণে অংশগ্রহণ করি|  

প্রিয় দেশবাসী,

৯. মানব সমাজের একে অন্যকে সহায়তা করার এতটা প্রয়োজন এর আগে অনুভূত হয়নি, যা আজ হচ্ছে| এখন দু’বছরেরও বেশি সময় চলে গেছে, কিন্তু করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানব সমাজের লড়াই আজও চলছে| এই মহামারিতে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন| গোটা বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থার উপরে আঘাত এসেছে| বিশ্ববাসীকে অভূতপূর্ব বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে| তিনটি নতুন রূপ নিয়ে এই ভাইরাস নতুন নতুন সংকট তৈরি করছে| এই পরিস্থিতি মানব সমাজের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে|   

১০. অতিমারীর মোকাবিলা করা ভারতে অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজ ছিল| আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি| আর উন্নয়নশীল অর্থ ব্যবস্থার কারণে আমাদের কাছে এই অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়াই করার উপযুক্ত ক্ষেত্রের প্রাথমিক পরিকাঠামো তথা প্রয়োজনীয় সম্পদ পর্যাপ্ত মাত্রায়  ছিল না| কিন্তু এই ধরনের কঠিন সময়েই কোনো রাষ্ট্রের লড়াই করার ক্ষমতা প্রকাশ পায়| এটা বলতে গিয়ে আমার গর্ব অনুভব করি যে, আমরা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অসাধারণ দৃঢ় সংকল্প আর দক্ষতা প্রদর্শন করেছি| করোনা ভাইরাসের প্রথম বছরের মধ্যেই আমরা স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রাথমিক পরিকাঠামোকে প্রসারিত ও শক্তিশালী করেছি এবং অন্য দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্যও এগিয়ে গেছি| দ্বিতীয় বছরে আমরা দেশীয় টিকা উদ্ভাবন করে নিয়ে বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টিকাকরণ অভিযান শুরু করে দিয়েছি| এই অভিযান দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে| আমরা অনেক দেশকে টিকা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত অন্য সরঞ্জাম পাঠিয়েছি| বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ভারতের এই অবদানের প্রশংসা করেছে |  

১১. দুর্ভাগ্যবশত, সংকটের এই পরিস্থিতি বারবার আসছে| কারণ ভাইরাস, নিজেদের পরিবর্তিত রূপ নিয়ে ফিরে আসছে| অগণিত পরিবার ভয়ানক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে গেছে| এই পরিস্থিতিতে বেদনা প্রকাশের মত শব্দ আমার কাছে নেই| কিন্তু একমাত্র সান্ত্বনা এটাই যে, বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা করা গেছে| মহামারীর প্রভাব এখনও ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে| তাই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে আর নিজেদের রক্ষায় কোনোভাবে শৈথিল্য দেখালে চলবে না| এখন পর্যন্ত আমরা যেসব সতর্কতা অবলম্বন করেছি, এগুলোকে চালিয়ে যেতে হবে| মাস্ক পরা ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কোভিড বিধির অনিবার্য অঙ্গ| কোভিড মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞদের বলে দেওয়া সতর্কতা মেনে চলা আজ প্রতিটি দেশবাসীর রাষ্ট্রধর্মে পরিণত হয়েছে| এই সংকট দূর হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদেরকে এই রাষ্ট্রধর্ম পালন করে যেতে হবে|  

১২. সংকটের এই সময়ে আমরা এটা দেখেছি যে, কিভাবে আমরা সমস্ত দেশবাসী একটি পরিবারের মত পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছি| শারীরিক দূরত্বের কঠিন সময়ে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতা অনুভব করেছি| আমরা অনুভব করেছি যে, আমরা একে অন্যের উপর কতটা নির্ভরশীল| কঠিন পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, এমনকি রোগীর সেবা শুশ্রুষার জন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে চিকিৎসক, নার্স এবং প্যারামেডিকেল কর্মীরা মানবতার সেবা করেছেন| আবশ্যিক প্রয়োজনীয় সুবিধা বজায় রাখা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে যাতে কোনো  ধরনের বাধা না আসে, তা সুনিশ্চিত করতে বহু মানুষ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে গেছেন| কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের সরকারি কর্মচারী, নীতি প্রণয়নকারীরা, প্রশাসকরা ও অন্য অনেকে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন|

১৩. এসব প্রচেষ্টার জন্যই আমাদের অর্থনীতি পুনরায় গতিশীল হয়েছে। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভারতের দৃঢ়তার এটাই বড় প্রমাণ যে গত বছর আর্থিক উন্নয়নে আসা মন্দার পর বর্তমান অর্থবর্ষে সেটা কাটিয়ে দেশের আর্থিক ব্যবস্থা গতিশীল হয়ে ওঠার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।  এটা গত বছর শুরু করা আত্মনির্ভর ভারত কর্মসূচির সাফল্যকেও তুলে ধরে। সমস্ত আর্থিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন এবং প্রয়োজন অনুসারে সহায়তা প্রদান করতে সরকার নিরন্তর সক্রিয় রয়েছে। এরকম শক্তিশালী আর্থিক সাফল্যের পেছনে কৃষি এবং উৎপাদন ক্ষেত্রের জন্য নানা পরিবর্তনের ব্যাপক অবদান রয়েছে। আমি এটা জেনে খুশি হয়েছি যে, দেশের কৃষক, বিশেষ করে ছোট জোত জমির মালিক, অল্পবয়সী কৃষকরা প্রাকৃতিক চাষকে উৎসাহের সঙ্গে আপন করে নিচ্ছেন।    

১৪. সাধারণ মানুষের জন্য রোজগারের ব্যবস্থা করা তথা আর্থিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্য ছোট ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। আমাদের উদ্ভাবনশীল যুব শিল্পোদ্যোগীরা স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে সাফল্যের নতুন নজির স্থাপন করেছেন। আমাদের দেশে তৈরি করা বিশাল এবং সুরক্ষিত ডিজিটাল পেমেন্ট প্লাটফর্মের সাফল্যের এক বড় উদাহরণ হল এর মাধ্যমে প্রতি মাসে কোটি কোটি ডিজিটাল লেনদেন করা হচ্ছে।  

১৫. জনসম্পদের সুবিধা নিতে অর্থাৎ, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে,  আমাদের চিরাচরিত মূল্যবোধ এবং আধুনিক কৌশলের আদর্শ মেলবন্ধনের মাধ্যমে সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় শিক্ষা নীতির মাধ্যমে উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলেছে। আমি এটা জেনে খুশি যে, বিশ্বের সামনের সারির পঞ্চাশটি উদ্ভাবনী অর্থনীতির মধ্যে ভারত নিজের স্থান করে নিয়েছে। এই সাফল্য আরও তৃপ্তিদায়ক যে আমরা ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিকরণের পাশাপাশি যোগ্যতাকেও উৎসাহ জোগাতে সক্ষম।

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,

১৬. গতবছর অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাদের খেলোয়াড়দের অসাধারণ সাফল্য দেশবাসীর মনে খুশির ঢেউ তুলেছিল। সেই তরুণ বিজয়ীদের আত্মবিশ্বাস আজ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

১৭. বিগত মাসগুলোতে আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষকে নিজেদের দায়বদ্ধতা ও কর্মদক্ষতায় দেশ ও সমাজকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অনেক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে দেখেছি। এর মধ্যে দুটি উদাহরণ আমি তুলে ধরব। ভারতীয় নৌ সেনা এবং কোচিন শিপইয়ার্ডের নিষ্ঠাবান টিমের সদস্যরা স্বদেশী এবং অত্যাধুনিক বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আইএসি বিক্রান্ত তৈরি করেছেন, যা আমাদের নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আধুনিক  সামরিক ক্ষমতার শক্তিতে এখন ভারতকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নৌ শক্তিগুলির মধ্যে পরিগণিত করা হচ্ছে। এটিকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম বলিষ্ঠ উদাহরণ বলা যেতে পারে। এর চেয়ে আলাদা এক বিশেষ অভিজ্ঞতা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। হরিয়ানার ভিওয়ানি জেলার সুই নামে একটি গ্রাম আছে। সেখানকার কয়েকজন সচেতন মানুষ নিজেদের সংবেদনশীল কর্মতৎপরতার মাধ্যমে 'স্ব-প্রেরিত আদর্শ গ্রাম যোজনা'র আওতায় নিজেদের গ্রামের খোলনলচে বদলে দিয়েছেন। নিজেদের গ্রাম এবং জন্মস্থানের মাটির প্রতি প্রাণের টান ও কৃতজ্ঞতার এটি একটি অনুকরনীয় উদাহরণ। কৃতজ্ঞ মানুষের মনে নিজের জন্মস্থানের মাটির প্রতি সারাজীবন মমতা ও শ্রদ্ধা বজায় থাকে। এরকম উদাহরণের মাধ্যমে আমার এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে উঠছে যে এক নতুন ভারত উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। শক্তিশালী ভারত এবং সংবেদনশীল ভারত। আমি বিশ্বাস করি , এই উদাহরণ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে অন্য দেশবাসীরাও নিজের নিজের গ্রাম এবং নগরের বিকাশে অবদান রাখবেন |     

১৮. এই প্রেক্ষিতে আমি দেশের সমস্ত মানুষের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানাতে চাইব| গত বছর জুন মাসে কানপুরের  দেহাত জেলাতে আমার নিজের জন্ম মাটি অর্থাৎ আমার গ্রাম পরৌঁখে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল| সেখানে পৌঁছে নিজে থেকেই আমার মনে নিজের গ্রামের মাটি কপালে ছোঁয়ানোর ইচ্ছে জেগে ওঠে। আসলে আমি বিশ্বাস করি যে, আমার গ্রামের মাটির আশীর্বাদের জোরেই আমি রাষ্ট্রপতিভবন পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পেরেছি। আমি বিশ্বের যেখানেই যাই, আমার গ্রাম , আমার ভারত আমার হৃদয়ে সদা জাগ্রত থাকে। ভারতের যে মানুষেরা নিজেদের পরিশ্রম ও প্রতিভায় জীবনের দৌড়ে এগিয়ে যেতে পেরেছেন , তাঁদের প্রতি আমার অনুরোধ যে, আপনারা নিজেদের শেকড়কে, নিজেদের গ্রাম- শহর, জনপদ এবং নিজের জন্মস্থানের মাটিকে সর্বদা মনে রাখবেন। এর সঙ্গে আপনারা সবাই নিজের জন্ম স্থান এবং দেশের যেভাবেই সেবা  করতে পারেন,  অবশ্যই করবেন। ভারতের সমস্ত সফল ব্যক্তি যদি নিজের নিজের জন্মস্থানের বিকাশের জন্য নিষ্ঠা ভরে কাজ করেন, তাহলে স্থানীয় বিকাশের ভিত্তিতে গোটা দেশই সমৃদ্ধি অর্জন করবে।  

প্রিয় দেশবাসীগণ,  

১৯. আজ আমাদের সৈনিক ও নিরাপত্তাকর্মীরা দেশের জন্য গৌরব বোধের ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হিমালয়ে অসহ্য ঠান্ডায় এবং মরুভূমির প্রচন্ড গরমে নিজের পরিবার থেকে দূরে গিয়ে মাতৃভূমির সুরক্ষায় তাঁরা সক্রিয় থাকেন। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ দেশের সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাতদিন কড়া নজরদারী চালিয়ে যান, যাতে বাকি দেশবাসী নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যেতে পারেন। যখন কখনো কোন বীর সৈনিকের মৃত্যু হয় তখন গোটা দেশ শোকে আকুল হয়ে যায়। গত মাসে এক দুর্ঘটনাতে দেশের সবচেয়ে দুঃসাহসী কমান্ডারদের মধ্যে একজন - জেনারেল বিপিন রাওয়াত - তাঁর সহধর্মিনী এবং অনেক বীর যোদ্ধাদের আমরা হারিয়েছি। সেই দুর্ঘটনা  আমাদের দেশের মানুষকে অত্যন্ত শোকবিহ্বল করেছে।
ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ,

২০. দেশপ্রেমের ভাবনা দেশবাসীর কর্তব্যপরায়নতাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। তা সে আপনি ডাক্তার হোন কি আইনজীবী, দোকানদার হোন কি অফিস কর্মী , সাফাই কর্মচারী হোন বা শ্রমিক , নিজের দায়িত্ব পালনের কাজ  নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে করে যেতে পারাটাই দেশের জন্য আপনার প্রাথমিক ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

২১.  সশস্ত্র বাহিনীগুলির সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে আমার এটা উল্লেখ করতে আনন্দ হচ্ছে যে, এই বছর সশস্ত্র বাহিনীতে নারী ক্ষমতায়নের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মেয়েরা চিরাচরিত সীমানা অতিক্রম করেছেন, আর এখন তো অনেক নতুন ক্ষেত্রে মহিলা আধিকারিকদের স্থায়ী কমিশনে যাওয়ার সুবিধা চালু হয়ে গেছে। একই সঙ্গে সৈনিক স্কুলে তথা সুপ্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে মেয়েদের পড়াশোনার পথ প্রশস্ত হওয়ায় সেনাবাহিনীর ট্যালেন্ট পাইপলাইন তো সমৃদ্ধ হবেই, পাশাপাশি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে উন্নত লিঙ্গ ভারসাম্য বজায় থাকবে।   

২২.আমি বিশ্বাস করি যে, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার জন্য ভারত আজ বেশ ভালো জায়গায় আছে | একুশ শতককে  জলবায়ু পরিবর্তনের যুগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, আর ভারত অক্ষয় জ্বালানীর জন্য নিজের সাহসী ও উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যগুলি সামনে রেখে বিশ্বমঞ্চে নেতৃস্থানীয় জায়গায় চলে এসেছে | ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমরা প্রত্যেকে গান্ধীজীর পরামর্শ অনুসারে আশেপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি| ভারত সর্বদাই গোটা বিশ্বকে এক পরিবার হিসেবেই দেখে এসেছে| আমি বিশ্বাস করি যে বিশ্বব্যাপী বন্ধুত্বের এই ভাবনা নিয়ে আমাদের দেশ এবং গোটা বিশ্বের মানব সভ্যতা আরো বেশী সমহারে বিকশিত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে|  

প্রিয় দেশবাসীগণ,  

২৩. এই বছর যখন দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হবে ,  তখন আমরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ পথ অতিক্রম করবো| এই উপলক্ষ্যে আমরা ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ উদযাপন করছি| আমি এটা জেনে খুব আনন্দিত যে, বিপুল সংখ্যায় আমাদের দেশের মানুষ , বিশেষ করে আমাদের যুব সম্প্রদায় এই ঐতিহাসিক আয়োজনে অংশগ্রহন করছেন | এটা শুধু আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য নয় বরং আমাদের গোটা দেশের মানুষের জন্য নিজেদের অতীতের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হওয়ার একটি অসাধারণ সুযোগ| আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের গৌরবময় ঐতিহাসিক অভিযাত্রার এক অনুপ্রেরণাময় অধ্যায়| স্বাধীনতার এই ৭৫তম বর্ষযাপন জীবনের সেই মূল্যবোধগুলিকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার এক সুযোগ , যা থেকে একসময় আমাদের মহান জাতীয় আন্দোলন প্রেরণা পেয়েছিলো | আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক বীরাঙ্গনা ও বীরসন্তানেরা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন | স্বাধীনতা দিবস বা সাধারণতন্ত্র দিবসের মত জাতীয় উৎসবের আয়োজন না জানি কত কঠোর নিপীড়ন এবং আত্মবলিদানের ফসল ! আসুন, সাধারণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আমরা সবাই শ্রদ্ধায় সেই অমর শহীদদেরকেও স্মরণ করি !

প্রিয় দেশবাসীগণ,

২৪. আমাদের সভ্যতা প্রাচীন বটে, কিন্তু আমাদের এই গণতন্ত্র নবীন! দেশ গঠন আমাদের জন্য এক নিরন্তর চলতে থাকা একটি অভিযান| যেমনটা একটি পরিবারে হয়ে থাকে , ঠিক সেভাবে দেশেও হয়ে থাকে, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের উন্নততর ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে কঠোর পরিশ্রম করে যায় | আমরা যখন স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, তখন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ আমাদের ঘোরতর দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল | কিন্তু পরবর্তী পঁচাত্তর বছরে আমরা প্রভাব ফেলার মত প্রগতি সুনিশ্চিত করেছি | এখন যুব প্রজন্মকে স্বাগত জানাতে সুযোগের নতুন দরজা খুলে যাচ্ছে| আমাদের যুবসমাজ সেই সুযোগ গ্রহণ করে সাফল্যের নতুন উচ্চতার দ্যোতনা রচনা করে চলেছে | আমার বিশ্বাস, সেই প্রাণশক্তি, আত্মবিশ্বাস, এবং শিল্পোদ্যম নিয়ে আমাদের দেশ প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে থাকবে এবং নিজেদের ক্ষমতা অনুসারে বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের শ্রেষ্ঠ স্থান অবশ্যই দখল করতে পারবে |

২৫. আমি আপনাদের সবাইকে পুনরায় সাধারণতন্ত্র দিবসের আন্তরিক শুভকামনা জানাচ্ছি|

ধন্যবাদ , জয় হিন্দ!



(Release ID: 1792602) Visitor Counter : 575