প্রধানমন্ত্রীরদপ্তর

জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার, ২০২২ বিজয়ী শিক্ষকদের সঙ্গে কথোপকথনের পর প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

Posted On: 05 SEP 2022 10:38PM by PIB Kolkata

নয়াদিল্লি, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

 

আমার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সহযোগী ধর্মেন্দ্রজী, অন্নপূর্ণা দেবীজী এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাগত সমস্ত শিক্ষক বন্ধুগণ, আর আজ আপনাদের মাধ্যমে একভাবে আমি দেশের সমস্ত শিক্ষকদের সঙ্গেও কথা বলছি!

দেশ আজ ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং শিক্ষাবিদ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণজীকে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছে। এটা আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতিও একজন শিক্ষিকা। তাঁর কর্ম জীবনের গোড়ার দিকে তিনি শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করেছেন, আর তাও সুদূর ওডিশার প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখান থেকেই তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। আমাদের সকলের জন্য এটা অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, এরকম একজন শিক্ষিকা রাষ্ট্রপতির হাতে আপনারা সম্মানিত হয়েছেন। এটা আপনাদের সকলের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

দেখুন, আজ যখন দেশ স্বাধীনতার অমৃত কালে নিজের বিরাট স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়িত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণজীর নানা প্রচেষ্টা আমাদের সকলকে প্রেরণা যোগাচ্ছে। এই উপলক্ষে আমি আপনাদের মতো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সকল শিক্ষকদের পাশাপাশি, আজ বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্যস্তরে যাঁরা এই পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের সকলকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই।

বন্ধুগণ,

একটু আগেই আমার বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। তাঁরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা সবাই নানা ধরনের উদ্ভাবক প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষাদান করেন। ভাষা ভিন্ন, এলাকা ভিন্ন, তাঁদের সমস্যাগুলিও স্বতন্ত্র, কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় যতজনই হন না কেন, তাঁদের সকলের মধ্যে একটি বিষয় সমান – আর সেটি হ’ল, তাঁদের কর্ম, তাঁদের পড়ুয়াদের প্রতি সমর্পণ। আর এই সাধারণ গুণ থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে, যাঁরা সফল শিক্ষক, তাঁরা কখনই ছাত্রছাত্রীদের বলেন না যে, ভাই এই বিষয়টি তুমি পারবে না। ভালো শিক্ষকরা কখনই এভাবে বলেন না। ভালো শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় শক্তি হ’ল – তাঁরা অত্যন্ত ইতিবাচক হন। ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ায় যতই কাঁচা হোক না কেন, ভালো শিক্ষকরা বলবেন, চেষ্টা করো বাবা হয়ে যাবে! ঐ দেখ অমুকে করে নিয়েছে, তুমিও পারবে!

অর্থাৎ, আপনারা দেখবেন যে, একজন ভালো শিক্ষক নিজেও জানেন না যে, তিনি কত অবলীলায় এই গুণগুলি রপ্ত করে নেন।তিনি সবসময় ইতিবাচক কথাই বলেন।তিনি কখনও কোনও নেতিকে প্রশয় দেন না। নেতিবাচক মন্তব্য করে পড়ুয়াদের নিরাশ করেন না, কাউকে হতাশ করা তাঁর প্রকৃতির মধ্যে থাকে না। একজন প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকা হ’ল – ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠা। তিনি স্বপ্ন বপণ করেন। একজন ভালো শিক্ষকই প্রত্যেক শিশুর মনে স্বপ্ন বপণ করার পাশাপাশি, সেই স্বপ্নগুলিকে সংকল্পে পরিবর্তিত করার প্রশিক্ষণ দেন আর তাঁদেরকে সাহস যোগান যে, এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে। তুমি একবার সংকল্প নাও! আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, এই রকম প্রেরণা পেলে পড়ুয়ারা প্রকৃতই সেইসব স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে। অর্থাৎ, স্বপ্ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সম্পূর্ণ যাত্রাপথে তাঁদের সঙ্গে সেই আলোকবর্তিকা থাকে, যা কোনও শিক্ষক তাঁর জীবনে স্বপ্ন রূপে বপণ করেছিলেন, প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। সেই প্রদীপই তাঁকে সমস্ত সমস্যা ও প্রতিকূলতা অন্ধকারে আলোর পথ দেখায়।

আজ যখন দেশ নতুন নতুন সংকল্প নিয়ে একটি এমন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বর্তমান প্রজন্ম যারা এখন ছাত্রছাত্রী, তাদের উপরই নির্ভর করছে ২০৪৭ সালে ভারত কিভাবে গড়ে উঠবে। আর সেই ছাত্রছাত্রীদের জীবন এখন আপনাদের হাতে। এর মানে হ’ল – ২০৪৭ সালের কথা ভেবে দেশ গঠনের কাজ আজকের শিক্ষকরা, যাঁরা আগামী ১০-২০ বছর শিক্ষকতা পেশায় থাকবেন, তাঁদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

সেজন্য আপনারা নিছকই একটি বিদ্যালয়ে চাকরি করেন না, শুধুই শ্রেণীকক্ষে গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ান না, শুধুই পাঠক্রম অনুসরণ করে নিজেদের দায়িত্ব পূরণ করেন না, আপনারা তার সঙ্গে পড়ুয়াদের জীবন গড়ার কাজও করেন। আর তাদের জীবন গড়ার মাধ্যমে আপনারা দেশ গঠনের স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। যে শিক্ষকের নিজের স্বপ্ন খুবই ছোট হয়, তাঁর মাথায় ১০টা-৫টা চাকরি করা, আর আজ এই সময়ের মধ্যে ৪টে পিরিয়ড নিতে হবে – এতটাই দায়বদ্ধতার সীমা থাকে। কাজেই তাঁর জন্য মাস গেলে বেতন পাওয়া, ১ তারিখের জন্য অপেক্ষা করাই জীবন। কিন্তু তিনি কখনও সেই আনন্দ পান না, যাকে শিক্ষকতার প্রকৃত আনন্দ বলা হয়। তাই, তাঁর পেশা ক্রমশই তাঁর কাছে বোঝা হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন তাঁর পেশা তাঁর স্বপ্নগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন আর কোনও কিছুকে বোঝা বলে মনে হয় না। তখন তাঁর মনে হয়, আরে আমার কাজের মাধ্যমে তো আমি দেশ গঠনের জন্য এত বড় অবদান রাখবো। আমি যদি ক্রীড়া ক্ষেত্রে একজন ভালো খেলোয়াড় তৈরি করতে পারি, আর তার মনে সেই স্বপ্ন জাগিয়ে তুলতে পারি যে, কখনও না কখনও, বিশ্বের কোথাও না কোথাও আমাদের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার সামনে তাকে সাফল্যের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চাই…! আপনারা কল্পনা করতে পারেন – তখন সেই কাজে আপনারা কতটা আনন্দ পাবেন। তখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য রাতের পর রাত জেগেও আপনারা আনন্দ পাবেন।

তাই, শিক্ষকদের মনে শুধুই ক্লাস রুম, শুধুই তাঁদের জন্য বরাদ্দ পিরিয়ড, কোন শিক্ষক স্কুলে এসেছেন, কোন শিক্ষক আসেননি, তার বদলে অতিরিক্ত ক্লাস নিতে হবে কি না – এই সমস্ত বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। আমি আপনাদের সমস্ত সমস্যা জানি, তাই বলছি, আপনাদের নিজেদেরকে মানসিক বোঝা থেকে মুক্ত করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, তাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সবশেষে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের তো পড়াতে তো হবেই, জ্ঞান বিতরণও করতে হবে। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের দায়িত্ব, তাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করা। দেখুন, বিচ্ছিন্নভাবে ঢিমেতেতালে জীবন গড়ে তোলা যায় না। যদি এমন হয় যে, শ্রেণীকক্ষে তাদের একরকম পড়ানো হ’ল,  স্কুল পরিসরে তারা অন্যরকম দেখলো, আর বাড়ির পরিবেশে আরও বিপরীত কিছু দেখলো; তখন একটি শিশু দ্বন্দ্ব এবং বিরুদ্ধাভাসের জালে জড়িয়ে পড়ে। তার মনে হয়, মা তো এই কথা বলছিল, আর শিক্ষক এই কথা বলছেন, আর ক্লাসের অন্য বন্ধুরা আরেক কথা বলছে। শিশুদের মন থেকে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করাই আমাদের কাজ। কিন্তু এর জন্য কোনও ইঞ্জেকশন বা টিকা নেই। তাই শিক্ষকদের উচিৎ, একটি সংহত দৃষ্টিকোণ নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আপন করে নেওয়া।

ক’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের পরিবারের সদস্যদের চেনেন? ক’জন তাদের বাড়িতে গেছেন? ক’জন অন্ততঃপক্ষে একথা একান্তে জিজ্ঞেস করেছেন যে, বাড়ি গিয়ে সে কী করে? কিভাবে করে? তার দিন কিভাবে কাটে? ক’জন তাদের বাবা-মা’কে ডেকে বলেছেন যে, আমার ক্লাসে আপনার ছেলে বা মেয়ে আসে, তার মধ্যে এই বিশেষ শক্তি রয়েছে। আপনারা বাড়িতে ওকে একটু দেখবেন, তা হলে ও অনেক দূর যাবে। আমি তো আছি। শিক্ষক হিসাবে কখনও কোনও খামতি রাখবো না। কিন্তু আপনারাও আমাকে একটু সাহায্য করুন!

এভাবে আপনারা সেই শিশুটির বাড়ির মানুষের মনেও একটি স্বপ্ন বপণ করে আসতে পারবেন। ফলে, এই অভিযানে তাঁরাও আপনার সহযাত্রী হয়ে উঠবেন। তখন দেখবেন, তাঁদের বাড়িতেও অবলীলায় আপনার পাঠশালার শিষ্টাচার চালু হয়ে গেছে। যে স্বপ্নগুলি আপনারা ক্লাস রুমে বপণ করেন, সেই স্বপ্নগুলি তখন ছাত্রছাত্রীদের বাড়ির ফুলের বাগানে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করবে। সেজন্য আপনাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। হয়তো দু-একটি ছাত্রছাত্রী আপনাদের খুবই সমস্যায় ফেলবে। সে এতই অবুঝ যে অন্যদের সময় খারাপ করে দেয়। ক্লাসে ঢুকতেই আপনার প্রথম দৃষ্টি ওর দিকেই পড়ে, মেজাজ বিগড়ে যায়। আর সেও জানে যে, শিক্ষক আমাকে পছন্দ করেন না। সেজন্য সে ইচ্ছে করেই প্রথম বেঞ্চে এসে বসে। আর আপনার অর্ধেক সময় ও একাই খেয়ে নেয়।

এক্ষেত্রে অন্যান্য পড়ুয়াদের প্রতি অন্যায় তো হয়ই, আর সেই অন্যায়ের কারণ হ’ল আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। কিন্তু সফল শিক্ষক তিনিই হন, যিনি সকল ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেন না। তাঁর জন্য প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীই সমান। আমি এরকম অনেক শিক্ষককে দেখেছি। তাঁর নিজের সন্তানও হয়তো সেই ক্লাসে রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজের সন্তানকে ততটাই গুরুত্ব দেন, যতটা বাকি ছাত্রছাত্রীদের দেন। তিনি ভাবেন, বাবা-মার কর্তব্য আমি বাড়িতে পালন করবো। কিন্তু ক্লাসে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের জন্য যা বরাদ্দ, আমার সন্তানের ক্ষেত্রেও তাই হবে। পারিবারিক সম্পর্ক ক্লাস রুমে আসতে দেব না।

যিনি এরকম ত্যাগ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়, ভারতে যে নিজেকে সংযত রেখে কাজ করার পরম্পরা রয়েছে, তা কখনই শুধু পড়ার বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, কোনও কালেই থাকেনি। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তক একটি অবলম্বন মাত্র। আমরা অনেক কিছু এর বাইরে থেকে শিখি। আজ প্রযুক্তির কারণে এটা আরও বেশি সম্ভব হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে অনুভব করছি যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এখন আমাদের গ্রামের শিক্ষকরাও নিজেদেরকে প্রযুক্তিকে প্রশিক্ষিত করে তুলছেন। আর পড়ুয়াদের শেখাতে শেখাতে নিজেরা আরও ভালোভাবে শিখছেন। এখন তাঁরাও ছাত্রছাত্রীদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে পাঠ্যক্রমের বাইরে অনেক কিছু শেখাচ্ছেন এবং ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করতে পারে।

সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের মনে কী থাকে? তাঁদের মাথায় থাকে পরিসংখ্যান। আরও কতজন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, কোন স্কুলে কোন ক্লাসে কতজন ছাত্রছাত্রী স্কুলছুট হয়েছে, এলাকার কন্যা সন্তানরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে কি হয়নি – এইসব কিছু তাঁদের মাথায় থাকে। কিন্তু একজন শিক্ষকের মাথায় থাকে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের জীবন গড়ার চিন্তা। এই দুই ভাবনার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সেজন্যই  শিক্ষকরা এত দায়িত্ব অবলীলায় পালন করতে পারেন।

এখন আমাদের যে নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি এসেছে, তা সর্বস্তরে প্রশংসিত হচ্ছে। আপনারা কি একবার ভেবে দেখেছেন, কেন এত প্রশংসিত হচ্ছে? এই শিক্ষা নীতিতে কোনও ত্রুটি নেই – এরকম দাবি আমি করতে পারি না। আমার মনে হয়, কেউ-ই এই দাবি করতে পারেন না। কিন্তু যাঁরা এই শিক্ষা নীতির ব্যবহারিক রূপকে অনুধাবন করেছেন, তাঁদের মনে হয়েছে যে, এটি প্রকৃতই পথ-প্রদর্শক নীতি হয়ে উঠেছে। এটি দেশকে সঠিক লক্ষ্যে নিয়ে যাচ্ছে। চলুন, আমরা সবাই সেই পথ ধরে এগিয়ে যাই।

আমাদের পুরনো অভ্যাসগুলি আমাদেরকে এতটাই আবিষ্ট করে রেখেছে যে, নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিকে একবার পাঠ করলে কিংবা কারও কাছ থেকে বিস্তারিত শুনলেই কাজ চলবে না। একবার কেউ মহাত্মা গান্ধীজীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ভাই আপনার মনে যখন কোনও সংশয় জাগে, কোনও সমস্যার সম্মুখীন হন – তখন কী করেন? তখন গান্ধীজী বলেন, আমি শ্রীমদ্ভগবদ গীতা পড়ি। সেখানেই অনেক উত্তর পেয়ে যাই। বারবার পড়ি, বারবার তার অর্থ বদলায়, বারবার নতুন অর্থ অনুভব করি, বারবার নতুন আলোকবর্তিকা সামনে দেখতে পাই।

এই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিও এমনই, যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা, শিক্ষা জগতের মানুষরা এর মধ্যে সমস্ত সমস্যার সমাধান না খুঁজবেন, ১০-১২-১৫ বার ভালোভাবে না পড়বেন, সমাধান না খুঁজবেন – ততক্ষণ পর্যন্ত একে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন না। একবার এসেছে, সার্কুলার পেয়েছেন, চোখ বুলিয়ে নিলেন আর হয়ে গেলো - আপনাদের কাছে এই আচরণ প্রত্যাশা করি না! এই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতিকে আমাদের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত করতে হবে, আমাদের অস্তিত্বে আপন করে নিতে হবে। এরকম চেষ্টা যদি আপনারা করেন, তা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি রচনায় আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের বড় অবদান রয়েছে, তাঁদের এই পরিশ্রম সফল হবে।

প্রথমবার দেশে এত বড় আলাপ-আলোচনার মন্থন হয়েছে। যে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা এই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি রচনা করেছেন, তাঁরা আপনাদের কথা মাথায় রেখেই এটি রচনা করেছেন। সরকারি ভাষা ইত্যাদি পড়ুয়ারা বুঝবে না। তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনাদেরকেই প্রকৃত মাধ্যম হয়ে উঠতে হবে। এই যে যত সরকারি নথিপত্র সেগুলি কিভাবে ছাত্রছাত্রীদের জীবনের ভিত্তি রচনা করবে, তা আপনাদের উপর নির্ভর করছে। আপনাদের ভেবে নিতে হবে যে, আমাকে এই নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুবাদ করতে হবে। এর প্রতিটি দাড়ি কমা সহ প্রতিটি শব্দকে সহজভাবে বুঝতে হবে এবং সরলভাবে বোঝাতে হবে। আমি মনে করি, যেভাবে কিছু নাটকের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়, কিছু প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা হয়, কিছু ব্যক্তিত্ব গঠন প্রতিযোগিতা হয় – এই সকল ক্ষেত্রে পড়ুয়াদেরকেও নতুন জাতীয় শিক্ষা নীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে সামিল হওয়া উচিৎ। কারণ, শিক্ষক যখন তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবেন, আর তারা যখন নতুন কিছু জানতে চাইবে, তখন দু-একটা নতুন জিনিস উঠে আসবে। সেজন্য এই ধরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ।

আপনারা জানেন যে, আমি এবছর ১৫ আগস্টে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে লালকেল্লার প্রাকার থেকে জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ রেখেছিলাম, তার একটা নিজস্ব ভিন্ন মেজাজ ছিল। আমি সেখানে ২০৪৭ সালকে মাথায় রেখে বক্তব্য রেখেছি। আর সেই বক্তব্যে আমি দেশবাসীর প্রতি পঞ্চ শপথের অনুরোধ রেখেছি। সেই ৫টি শপথ কী কী? আপনারা কি ক্লাস রুমে এই শপথগুলি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন? অথবা যখন স্কুলে জমায়েত হয়, তখন বলবেন, অমুক ছাত্র বা ছাত্রী প্রধানমন্ত্রীর প্রথম শপথটি পাঠ করে শোনাবে। আর অমুক শিক্ষক সেই শপথ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বোঝাবেন। মঙ্গলবার দ্বিতীয় শপথ নিয়ে আলোচনা হবে। বুধবার তৃতীয় শপথ নিয়ে। বৃহস্পতিবার চতুর্থ শপথ আর শুক্রবার পঞ্চম শপথ নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর পরের সপ্তাহে আবার এভাবে আলোচনা হবে। তখন অন্য কোনও ছাত্র বা ছাত্রী পাঠ করবে আর অন্য একজন শিক্ষক ব্যাখ্যা করবেন। অর্থাৎ, সারা বছর ধরে পাঠ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই শপথগুলির অর্থ কী, আমাদের কী কী করতে হবে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই তো এরকম ৫টি শপথ থাকা উচিৎ। প্রত্যেক নাগরিকের থাকা উচিৎ।

এভাবে যদি আমরা চালিয়ে যেতে পারি, তা হলে আমি মনে করি, এই পঞ্চ শপথ নিয়ে সর্বস্তরে যে প্রশংসা হচ্ছে, সকলে যেভাবে বলছেন, হ্যাঁ ভাই, এই ৫টি শপথ এমনই, যেগুলি আমাদের ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে দেবে। এই ৫টি শপথ আপনার স্কুলের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর কাছে কিভাবে পৌঁছে দেবেন, তাদের কিভাবে এগুলির সঙ্গে যুক্ত করবেন, তাদের জীবনে কিভাবে এগুলি প্রয়োগ করবেন – তা নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ভারতে এখন এমন কোনও ছাত্রছাত্রী যেন না থাকে, যার মাথায় ২০৪৭ সালের স্বপ্নকে আপনারা বপণ করেননি। আপনাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, বল ভাই, ২০৪৭ সালে তোমার বয়স কত হবে? হিসেব করো, তোমার হাতে এত বছর রয়েছে, তুমি বলো এত বছরে তুমি নিজের জন্য কী করবে আর দেশের জন্য কী করবে? হিসেব করো, ২০৪৭ সালের আগে তোমার হাতে কত বছর, কত মাস, কত দিন, কত ঘন্টা রয়েছে। তুমি প্রত্যেক ঘন্টার হিসেব দাও। আপনি দেখবেন, দ্রুত তাদের সামনে একটি সম্পূর্ণ চিত্রপট তৈরি হয়ে যাবে যে, আজকের একটি ঘন্টা চলে গেল, ২০৪৭ সাল আরও এক ঘন্টা এগিয়ে এলো। ২ ঘন্টা চলে গেল, ২০৪৭ আরও এগিয়ে এলো। ২০৪৭ সালের আগে আমাকে এত কিছু করতে হবে!

আমরা যদি ছাত্রছাত্রীদের মনমন্দিরে একটি নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চার করে নতুন উদ্দীপনার সঙ্গে এই মনোভাব রোপণ করতে পারি, তা হলে দেখবেন, দেশের সমস্ত ছাত্রছাত্রী তাদের এই স্বপ্নগুলি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে শুরু করবে। সারা পৃথিবীতে আমরা দেখেছি, উন্নয়ন তাদেরই হয়, যে দেশের মানুষ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে বড় বড় স্বপ্নের অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারেন। সংকল্প যদি বড় হয়, আর দূরদৃষ্টি নিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত থাকে, তা হলে সুফল আসতে বাধ্য।

ভারতে ১৯৪৭ সালের আগে ডান্ডি যাত্রা ১৯৩০-৪২ সালের সময়কালকে যেভাবে আলোড়িত করেছে, যেভাবে ‘ইংরেজ ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই ১২টি বছরের দিকে যদি আপনারা তাকান, দেখবেন, সমগ্র ভারত কিভাবে স্বাধীনতার জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনও মন্ত্র ছিল না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে স্বাধীনতার আকাঙ্খাই দেশের জনগণের মেজাজে পরিণত হয়েছিল। আজ সময় এসেছে, আমাদের জনমনে তেমনই একটি সুশাসন, রাষ্ট্র গৌরব এবং দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মেজাজ গড়ে তুলতে হবে।

আমার শিক্ষক বন্ধুদের উপর আমার সবচেয়ে বেশি ভরসা। শিক্ষা জগতের উপর আমার সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশা। আপনারা যদি এই প্রচেষ্টায় কায়মনোবাক্যে সমর্পিত হন, তা হলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা সেই স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়িত করতে পারবো। দেশের প্রতিটি গ্রামে নবীন প্রজন্মের মনে এই আকাঙ্খা জেগে উঠবে। এখন দেশ আর থেমে থাকতে চায় না। এই তো দেখুন, দু’দিন আগেই ২৫০ বছর ধরে যারা আমাদের শাসন করে গেছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে সেই দেশকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে এসেছি। আজ আমরা বিশ্বের ৬ নম্বর থেকে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হয়েছি। এই উত্তরণ যতটা আনন্দদায়ক, তারচেয়ে বেশি আনন্দদায়ক হ’ল – ঐ দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া। কারণ, এই উত্তরণ ভারতের জন্য বিশেষ। কারণ, আমরা তাদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি। আমাদের মস্তিষ্কে সেই মনোভাব পুনর্জাগরিত করেছে। সেই ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকার উদ্দীপনা ১৫ আগস্টের উদ্দীপনা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

এবার ১৫ আগস্ট তারিখে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা যেভাবে আন্দোলিত হয়েছিল, তার আলোকে এই বিশ্ব অর্থনীতিতে পঞ্চম স্থান এমনভাবে এসেছে, তা আমাদের মনে গর্ব জাগিয়ে তুলেছে। আমার তেরঙ্গা পতাকা আরও বেশি করে আন্দোলিত হবে – এই মেজাজ খুব জরুরি। আর সেজন্য ১৯৩০-১৯৪২ সাল পর্যন্ত দেশবাসীর যে মেজাজ ছিল, দেশের জন্য বাঁচার, দেশের জন্য লড়াই করার, আর প্রয়োজন হলে দেশের জন্য আত্মবলিদানের – আজ সেই মেজাজকেও পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

আমি আমার দেশকে পেছনে থাকতে দেব না। হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে আমরা বেরিয়ে এসেছি। এখন সুযোগ এসেছে, আমরা আর থামবো না, আমরা এগিয়ে যাবো – এই মেজাজ দেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ আমাদের সমস্ত শিক্ষককে নিতে হবে। তা হলেই দেখবেন, এই শক্তি অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে।

আমি আরেকবার আপনাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। যাঁরা এত ভালো কাজ করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদেরকে এই পুরস্কারের পাশাপাশি, আমি আরও বেশি কাজ দিতে চাই। যাঁরা প্রকৃতই কাজ করেন, তাঁদেরকেই তো কাজ দেওয়ার ইচ্ছে হয়। যাঁরা করেন না, তাঁদের কে কাজ দেন। বরাবরই শিক্ষকদের প্রতি আমার ভরসা রয়েছে। তাঁরা যে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তা তাঁরা অবশ্যই বাস্তবায়িত করেন। সেজন্য আমি আপনাদের প্রতি এই আবেদন রাখলাম। আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভ কামনা জানাই।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।
 

PG/SB/SB



(Release ID: 1857312) Visitor Counter : 623