প্রধানমন্ত্রীরদপ্তর
azadi ka amrit mahotsav

লেক্স ফ্রিডম্যানের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথোপকথন

प्रविष्टि तिथि: 16 MAR 2025 11:47PM by PIB Kolkata

নয়াদিল্লি, ১৬ মার্চ ২০২৫

 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী: আমার শক্তি মোদী হওয়াতে নেই; আমার শক্তি আসে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর থেকে, আসে আমাদের জাতির হাজার হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ইতিহাস থেকে। সেটাই আমার প্রকৃত শক্তি। আমি যেখানেই যাই, মোদী হিসেবে যাই না— বেদ থেকে বিবেকানন্দ, আমাদের সভ্যতার হাজার বছরের মহৎ ঐতিহ্য সঙ্গে নিয়ে যাই। আমি    ১৪০ কোটি মানুষের, তাদের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধি। তাই আমি যখন কোনো বিশ্বনেতার সঙ্গে হাত মেলাই, তখন সেটা শুধু মোদীর হাত নয়—এটা ১৪০ কোটি ভারতবাসীর যৌথ হাত। আমার শক্তি মোদীর নয়; এটা ভারতবর্ষের শক্তি। আমরা যখন শান্তির কথা বলি, তখন সারা পৃথিবী শোনে, কারণ এটাই বুদ্ধের ভূমি, এটাই মহাত্মা গান্ধীর ভূমি। আমরা সংঘর্ষের পক্ষপাতী নই; আমরা সুরক্ষার পক্ষে। আমরা প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চাই না, আবার দেশগুলির মধ্যে সমস্যা ও চাই না — আমরা সহমতের পক্ষে। আর শান্তির চেষ্টা করেছি। আমি চরম দারিদ্র্য দেখেছি, তবুও কখনো বোঝা মনে করিনি। যে সারাজীবন জুতো পরে এসেছে, হঠাৎ খালি পা হলে তার কষ্ট হবে। কিন্তু যে কখনো জুতোই পরেনি, তার কোনো অভাববোধ নেই।

আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হলাম, সদ্ভাবনার নতুন সূচনার আশা নিয়ে পাকিস্তানকে আমার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিটি শুভ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। তবুও আমরা আশায় আছি যে তাঁরা শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগোবে। আমি বিশ্বাস করি, ওখানকার সাধারণ মানুষও ভালো ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করছে। সমালোচনা আমি কীভাবে সামলাই? এক কথায় বলি: আমি স্বাগত জানাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সমালোচনাই গণতন্ত্রের প্রাণ। সকল তরুণদের কাছে আমার বার্তা—জীবনে রাত যতই অন্ধকার হোক না কেন, মনে রেখো, সকাল অবশ্যই আসবে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি এখন শুনতে যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আমার কথোপকথন । এ আলোচনাটি আমার জীবনের এক অন্যতম অভিজ্ঞতা। এটা আমাকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করেছে, আর আমি সেটি তুলে ধরতে চাই। চাইলে আপনি সরাসরি আমাদের আলোচনা শুনতে পারেন।

নরেন্দ্র মোদীর জীবনকথা অসাধারণ। দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে তিনি বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নেতা হয়েছেন, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ পরিচালনা করছেন। তিনি একবার নয়, তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন, প্রত্যেকবারই নিরঙ্কুশ জনমত নিয়ে। নেতা হিসেবে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে। অগণিত সংস্কৃতি, সম্প্রদায় এবং জটিল ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি দেশ। তিনি সাহসী ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য পরিচিত। এর জন্য কোটি কোটি মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে, আবার অনেকেই সমালোচনা করে। আমাদের আলোচনায় আমরা এসব দিক গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছি। তিনি বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধার পাত্র। এমনকি দ্বন্দ্বে লিপ্ত দেশগুলির নেতাঁরাও — মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র - চীন, ইউক্রেন - রাশিয়া, ইসরায়েল - প্যালেস্টাইন কিংবা মধ্যপ্রাচ্য, তাঁকে শান্তির সৈনিক ও বন্ধু হিসেবে দেখে। তিনি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। ইতিহাসের এই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছি, মানবজাতি এক জটিল মোড়ে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে, সংঘর্ষ জাতিসীমা পেরিয়ে বিশ্বকে গ্রাস করতে পারে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে টানাপড়েন, সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশন পর্যন্ত প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি সমাজ ও ভূ-রাজনীতিকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। এই পরিবর্তন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন মহৎ নেতাদের — যারা বিভাজন নয়, ঐক্যের পথে এগোবেন; যারা শান্তিকে অগ্রাধিকার দেবেন, নিজেদের দেশকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি মানবতার কল্যাণকেও গুরুত্ব দেবেন। এই কারণেই আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আলাপচারিতা আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। কারো কাছে মনে হতে পারে আমি ক্ষমতার প্রভাবে আছি। কিন্তু তা নয় — কখনো ছিল না, কখনো হবেও না। আমি কাউকে পূজা করি না, বিশেষত ক্ষমতাশালীদের নয়। আমি ক্ষমতা, অর্থ বা খ্যাতির প্রতি আকৃষ্ট নই, কারণ এগুলো হৃদয়, মস্তিষ্ক ও আত্মাকে কলুষিত করতে পারে।

ক্যামেরার সামনে হোক বা পেছনে, আমার লক্ষ্য সবসময় মানুষের মন বোঝা — তাদের গুণ ও দোষ দুই ই। আমি সব জানতে চাই, ভালো হোক বা খারাপ। গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝি, আমরা সবাই একই রকম। প্রত্যেকের ভেতরেই আলো ও অন্ধকার আছে। আমাদের প্রত্যেকের সংগ্রাম ও আশা আছে—সে বিশ্বনেতা হোক, ভারতীয় শ্রমিক হোক, কিংবা আমেরিকার কৃষক। এ প্রসঙ্গে বলি, আমি আমেরিকার অনেক শ্রমিক ও কৃষকের সঙ্গে কথোপকথনের পরিকল্পনা করছি, ক্যামেরার আড়ালে হোক বা সামনে, যখন আমি বিশ্ব ও যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করব। নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে আমার কৌতূহল শুধু তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে নয়, তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও। ক্যামেরার সামনে ও আড়ালে তাঁর সঙ্গে কাটানো সময় ছিল গভীর আলোচনায় ভরপুর। আমাদের কথোপকথন ছিল উষ্ণ ও সহানুভূতিশীল, রসিকতায় ভরপুর, এবং প্রশান্ত। আমাদের কথোপকথন সময়ের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ ছিল না। আমি শুনেছি তিনি সবাইকে সমান সহানুভূতির সঙ্গে দেখেন, তাদের পরিচয় যাই হোক না কেন।  এটাই আমার অভিজ্ঞতাকে সত্যিই অসাধারণ করে তুলেছে, যা আমি কোনোদিন ভুলব না।

একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে — আপনি এই আলাপচারিতার সাবটাইটেল ইংরেজি, হিন্দি ও আরও কিছু ভাষায় পড়তে পারবেন। এছাড়াও, ভিডিওটি ওই ভাষাগুলিতে শোনা যাবে। দ্বিভাষিক ফরম্যাটও আছে — যেখানে আমি ইংরেজিতে বলব আর প্রধানমন্ত্রী মোদী বলবেন হিন্দিতে। চাইলে আপনার পছন্দের ভাষায় সাবটাইটেল চালু করতে পারবেন। ইউটিউবে আপনি "সেটিংস" আইকনে ক্লিক করে অডিও ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তন করতে পারবেন। তারপর "অডিও ট্র্যাক" এ গিয়ে আপনার পছন্দের ভাষা বেছে নিতে হবে। পুরো আলোচনা ইংরেজিতে শুনতে চাইলে "ইংরেজি" নির্বাচন করুন, হিন্দির জন্য "হিন্দি"। আর আসল ফরম্যাটে — যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদী হিন্দিতে বলছেন আর আমি ইংরেজিতে — শোনার জন্য "হিন্দি (লাতিন)" অডিও ট্র্যাক বেছে নিন। এক বা দুই ভাষায় শোনার সুযোগ আছে, আর সাবটাইটেলও পাবেন আপনার পছন্দমতো। ভিডিওটির মূল ভাষা ইংরেজি। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই 'ইলেভেন ল্যাবস' এবং অনুবাদক দলের প্রতি।

আমরা চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী মোদীর ইংরেজি কণ্ঠস্বরকে এআই ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মত শোনাতে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ভাষা আমাদের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানো উচিত নয়। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব এই কথোপকথন বিশ্বজুড়ে সকল মানুষের কাছে তাদের ভাষায় পৌঁছে দিতে। আবারও সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এটা আমার জন্য এক অসাধারণ যাত্রা, আর আপনাদের নিরন্তর সমর্থন আমাকে সম্মানিত করেছে। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। আপনারা এখন দেখছেন "লেক্স ফ্রিডম্যান পডকাস্ট"। তো বন্ধুরা, আপনারা এখন শুনতে চলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আমার কথোপকথন।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি একটা কথা বলতে চাই — আমি উপবাসে আছি। প্রায় ৪৫ ঘণ্টা, অর্থাৎ দুই দিন ধরে আমি শুধু জল খেয়েছি, খাবার কিছুই খাইনি। আমি এই উপবাস করেছি আপনাকে সম্মান জানাতে এবং এই আলোচনার প্রস্তুতি হিসেবে, যাতে আমরা এক গভীর, আধ্যাত্মিক স্তরে কথা বলতে পারি। আমি শুনেছি আপনিও নিয়মিত উপবাস করেন। আপনি কি বলতে পারেন, আপনার জীবনে উপবাসের গুরুত্ব কী এবং উপবাসের সময় আপনার মানসিক অবস্থা কেমন থাকে?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমেই বলি, আমি সত্যিই বিস্মিত যে আপনি উপবাস করেছেন, আর সেটা এই কথোপকথনের প্রতি সম্মান জানিয়ে। আমি আন্তরিকভাবে আপনার এই উদ্যোগের প্রশংসা করি। ভারতে ধর্মীয় ঐতিহ্য কেবল আনুষ্ঠানিক নয়, জীবনযাপনের পথ। শুধু পূজাপদ্ধতি নয়, বরং এক সম্পূর্ণ জীবনদর্শন হিসেবে আমাদের শীর্ষ আদালত সুন্দরভাবে হিন্দুধর্মকে বর্ণনা করেছে। আমাদের শাস্ত্র শরীর, মন, বুদ্ধি, আত্মা ও মানবতাকে উন্নত করার নানা উপায় বর্ণনা করেছে, আর উপবাস তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তবে উপবাস একমাত্র দিক নয়। সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপবাস ভেতরের ও বাইরের নিয়মানুবর্তিতা গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। সহজ ভাষায় বললে, যারা ভারতের সঙ্গে পরিচিত নয় তাদের বোঝাতে বলব — উপবাস জীবন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, দুই দিন শুধু জলে উপবাসের পর আপনার ইন্দ্রিয়গুলো — বিশেষ করে গন্ধ, স্পর্শ ও স্বাদ — অবিশ্বাস্যভাবে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। এখন হয়তো আপনি জলের হালকা গন্ধও পাচ্ছেন, যা আগে কখনো টের পাননি। কেউ যদি আপনার পাশ দিয়ে চা বা কফি নিয়ে যায়, আপনি সঙ্গে সঙ্গে তার গন্ধ চিনে ফেলবেন। ছোট একটি ফুলের দিকেও তাকালে তা নতুনভাবে অনুভব করবেন।

মূলত, উপবাসে ইন্দ্রিয়গুলো হঠাৎ অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে, আর তাদের গ্রহণ ও প্রতিক্রিয়া করার ক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা। এছাড়া আমি লক্ষ্য করেছি উপবাসে আমার চিন্তাধারা আরও তীক্ষ্ণ হয়, প্রচলিত ভাবনার বাইরে নতুন চিন্তা আসে। জানি না অন্যদেরও এই অভিজ্ঞতা হয় কি না, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে হয়েছে।

অনেকে ভাবে উপবাস মানেই খাওয়া ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু এটা শুধু শারীরিক। কেউ যদি কোনো কারণে খেতে না পায়, তার পেট খালি থাকে, সেটা উপবাস নয়। উপবাস এক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। যেমন আমি দীর্ঘদিন ধরে উপবাস করি, আর শুরু করার আগে নানা প্রস্তুতি নিই। উপবাস শুরু হওয়ার ৫–৭ দিন আগে আয়ুর্বেদীয় নিয়ম, যোগাসন আর শারীরিক বিশুদ্ধির নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করি। এরপর উপবাসের ঠিক আগে প্রচুর জল পান করি, যাতে শরীর শুদ্ধ হয় এবং ডিটক্সের জন্য প্রস্তুত হয়। আমার কাছে উপবাস ভক্তি, শৃঙ্খলা। বাইরের যত কাজই করি, ভেতরে ভেতরে আমি গভীরে ডুবে থাকি। এটা এক গভীর অভিজ্ঞতা, এক অনন্য অনুভূতি। আমার উপবাসের অভ্যাস কোনো বই, উপদেশ বা পারিবারিক প্রথা থেকে আসেনি — এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় গরু রক্ষার জন্য সারা দেশে এক আন্দোলন হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর প্রেরণায়। তখন সরকার কোনো আইন করেনি, আর আন্দোলনের অংশ হিসেবে সর্বত্র এক দিনের উপবাস পালন করা হতো। আমি তখন শিশু, প্রাইমারি স্কুল সবে শেষ করেছি, কিন্তু অংশগ্রহণের তাগিদ অনুভব করেছিলাম। ওটাই ছিল আমার প্রথম উপবাসের অভিজ্ঞতা। অল্প বয়সেই খিদে পায়নি, খাওয়ার ইচ্ছেও হয়নি। বরং নতুন এক সচেতনতা ও শক্তি অনুভব করেছিলাম। তখনই বুঝেছিলাম উপবাস শুধু না খাওয়া নয়, এক গভীর বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি বহু পরীক্ষা করেছি, শরীর ও মনকে গড়ে তুলেছি উপবাসের মাধ্যমে। আর এত দীর্ঘ যাত্রার পর দেখেছি, আমার কর্মক্ষমতা কখনো কমে না। বরং অনেক সময় উপবাসের সময় আমি আরও বেশি কাজ করি। আরেকটি আশ্চর্য ব্যাপার — আমি অবাক হই কত সহজে ভাবনা আসে। জানি না এসব চিন্তা কোথা থেকে আসে, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা সত্যিই অসাধারণ।

লেক্স ফ্রিডম্যান: তাহলে উপবাস চলাকালীনও আপনি বিশ্বনেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আর মাঝে মাঝে টানা ন দিন পর্যন্ত উপবাস করেন?

প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ, আর এর পেছনে দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। হয়তো শ্রোতাদের কাছে বিস্ময়কর শোনাবে, তবুও আমি বলব।

ভারতে ‘চতুর্মাস’ নামে এক প্রথা আছে, যা বর্ষাকালে পালিত হয়। মনে করা হয় এই সময়ে হজমশক্তি দুর্বল থাকে, তাই চার মাস দিনে একবার খাওয়া হয়। আমার জন্য এ টা জুনের মাঝামাঝি শুরু হয়, দীপাবলির পর পর্যন্ত চলে, সাধারণত নভেম্বর পর্যন্ত। এরপর আসে ‘নবরাত্রি’, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে নয় দিনের উৎসব, দেবী দুর্গার উপাসনা উপলক্ষে। এই সময় আমি শুধু গরম জল পান করি। আসলে ছোটবেলা থেকে গরম জল খাওয়ার অভ্যাস আছে, সেটা এখনো বজায় রেখেছি। আরেকটি ‘নবরাত্রি’ হয় মার্চ-এপ্রিলে, যাকে বলে ‘চৈত্র নবরাত্রি’। এ বছর সম্ভবত সেটা ৩১শে মার্চ শুরু হবে। তখন আমি প্রতিদিন এক ধরনের ফল খাই। যেমন, যদি পেঁপে বেছে নিই, তাহলে নয় দিন প্রতিদিন একবার শুধু পেঁপেই খাই।

বছরের পর বছর ধরে এসব উপবাস প্রথা আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। প্রায় ৫০–৫৫ বছর ধরে আমি এগুলো পালন করছি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: কখনও কি আপনি উপবাসে থাকাকালীন বিশ্বের বড় নেতাদের সঙ্গে আপনার বৈঠক হয়েছিল? তাঁরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? আপনি খাবার ছাড়া থাকতে পারেন দেখে তাঁরা কি বিস্মিত হয়েছিলেন? আর আমি বলতে চাই, আপনি ঠিক বলেছেন। দু’দিন উপবাস করার পর আমি একধরনের তীব্র সচেতনতা আর উপলব্ধি করার বাড়তি ক্ষমতা অনুভব করছি । এটা সত্যিই এক গভীর অভিজ্ঞতা। কোনো বিশ্বনেতার উপস্থিতিতে উপবাস করার কোনো বিশেষ ঘটনা আপনার কি মনে পড়ে ?

প্রধানমন্ত্রী: আসলে আমি সাধারণত কাউকে সেটা জানতে দিই না। আমার কাছে উপবাস একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়, আর আমি কোনোদিনও এর প্রচার চাইনি। আমি মুখ্যমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই মানুষ এটা জানতে শুরু করেছিল। তার আগে এটা সবসময় আমার ব্যক্তিগত জীবনের অংশ ছিল। এখন যেহেতু এটা জানা গেছে, আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় তখন আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি, এই আশায় যে হয়তো কারও কাজে লাগবে। আমার কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই, শুধু অভিজ্ঞতা আছে যা হয়তো অন্যের উপকার করতে পারে। আমার পুরো জীবনটাই জনগণের জন্য উৎসর্গ করা। যেমন, আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হলাম, তখন হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রপতি ওবামার সঙ্গে আমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছিল। সেখানে একটি আনুষ্ঠানিক ডিনারের ব্যবস্থা ছিল। আলোচনার সময় বলা হয়েছিল যে ডিনারের আয়োজন থাকবে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী খাবেন না। এতে কিছুটা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল — এত বড় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অতিথি করে ডিনার আয়োজন করা হচ্ছে, অথচ তিনি কিছু খাবেন না! আমরা যখন টেবিলে বসলাম, তাঁরা আমার সামনে এক গ্লাস গরম জল নিয়ে এলেন। আমি মজা করে রাষ্ট্রপতি ওবামার দিকে তাকিয়ে বললাম, “দেখুন, আমার ডিনার এসে গেছে!” এবং সেই গ্লাসটা তাড় সামনে রাখলাম। পরে আবার যখন গেলাম, তিনি সেটা মনে রেখেছিলেন। তিনি বললেন, “গতবার আপনি উপবাসে ছিলেন, কিন্তু এবার আপনি দুপুরে খেয়েছেন। তো, এবার উপবাস নয়—এবার আপনাকে দ্বিগুণ খেতে হবে!”

লেক্স ফ্রিডম্যান: এবার আসি আপনার শৈশবের কথায়। আপনি এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আপনার এই যাত্রা অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা। আপনার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল না, আর আপনি শৈশবে মাটির ছোট ঘরে পুরো পরিবার নিয়ে থাকতেন। আপনার শৈশবের কিছু স্মৃতির কথা বলবেন? সীমিত সম্পদের মধ্যে বেড়ে ওঠা কীভাবে আপনার ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছিল?

প্রধানমন্ত্রী: আমার জন্ম উত্তর গুজরাটের মেহসানা জেলার এক ছোট শহর ভদনগরে। ভদনগর এক ঐতিহাসিক শহর, আর সেখানেই আমার জন্ম ও শিক্ষা। আজকের পৃথিবীকে ভেবে দেখি, আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি তা সত্যিই আলাদা, হয়তো বিরলও বলা যায়। যখন আমি স্কুলে পড়তাম, আমাদের গ্রামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি আমাদের উৎসাহ দিতেন — “যদি কোনো খোদাই করা পাথর, শিলালিপি বা প্রাচীন কোনো নিদর্শন পাও, স্কুলের ওই কোণে নিয়ে এসো ।” তাঁর কথায় আমার কৌতূহল জাগে। পরে বুঝলাম, আমাদের গ্রামটার ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ ও প্রাচীন। স্কুলে এ নিয়ে আলোচনা হতো, আর এতে আমার আগ্রহ আরও গভীর হয়। পরে একদিন আমি খবরের কাগজে পড়লাম এক চীনা ছবির কথা, যেখানে হিউয়েন সাং নামের চীনা দার্শনিক ও পরিব্রাচকের উল্লেখ ছিল। জানতে পারলাম, তিনি কয়েক শতাব্দী আগে আমাদের গ্রামে অনেকদিন কাটিয়েছিলেন। কারণ, ভদনগর একসময় গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল । ঐতিহাসিক দলিলে পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় ১৪০০ সাল থেকেই এখানে বৌদ্ধ শিক্ষা সমৃদ্ধ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি ভদনগরের আরও অনেক ঐতিহাসিক দিক জানতে পারি। ১২০০ সালের বিজয়স্তম্ভ, সপ্তদশ শতকের মন্দির, আর ষোড়শ শতকের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী দুই বোন তানা ও রিরির স্মৃতি। এসব জেনে আমি মুগ্ধ হই। পরে আমি মুখ্যমন্ত্রী হলে ভদনগরের ইতিহাস জানতে বড় করে খনন কাজ শুরু করি। সেখানে হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর অধ্যয়নের প্রমাণ পাওয়া গেল, আর দেখা গেল বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু সংস্কৃতির গভীর সংমিশ্রণ। ভদনগরে ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি দেয়াল যেন নিজেই কথা বলত। এসব খননে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অসাধারণ ঐতিহাসিক তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রমাণ পাওয়া গেছে, ভদনগরে প্রায় ২৮০০ বছর ধরে একটানা বসতি রয়েছে, অর্থাৎ প্রায় তিন সহস্রাব্দেরও বেশি নিরবচ্ছিন্ন সভ্যতার বিকাশ। আজ সেখানে প্রত্নতত্ত্ব শিক্ষার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি জাদুঘর তৈরি হয়েছে। আমার জন্মভূমি আমার কাছে বিশেষ অর্থ বহন করে। আর অদ্ভুত নিয়তির কারণে আমার কর্মভূমি কাশী। কাশী, বারাণসী বা বেনারস নামেও পরিচিত, এক প্রাচীন শহর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্ন জনবসতি এই কাশীতে।

এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয় যে ভদনগরে জন্মানো আমি পরে জীবনের কর্মক্ষেত্র হিসেবে কাশী পেলাম, মা গঙ্গার কোলেই জীবন কাটাতে লাগলাম। ছোটবেলায় আমি বাবা - মা, ভাইবোন, দাদু - ঠাকুমা, কাকা - কাকিমাদের সঙ্গে থাকতাম। আমাদের বাড়ি ছিল অতি সাদামাটা। ছোট্ট একটি ঘর, জানালা নেই, শুধু একটি দরজা। সেইখানেই আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। দারিদ্র্যের কথা যখন বলা হয়, সেটা আপেক্ষিকভাবে বোঝা যায়। আজ আমার কাছে বিভিন্ন আর্থিক স্তরের মানুষ আসেন, কিন্তু আমার শৈশব কেটেছে চরম দারিদ্র্যে। তবু আমি কখনো ওটাকে বোঝা মনে করিনি। যেমন ধরুন, কেউ যদি জুতো পরায় অভ্যস্ত হয় আর হঠাৎ সেটা না থাকে, তবে সে অভাব টের পাবে। কিন্তু যিনি কোনোদিন জুতোই পাননি, তাঁর জন্য সেটা কোনো অভাব নয়। আমি যেহেতু শৈশবে কোনোদিন জুতো পাইনি, তাই তার অভাব অনুভব করিনি। জীবন যেমন ছিল, তেমনই ছিল, কোনোদিন কারুর সাথে তুলনা করিনি। মা প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন, বাবাও তাই। বাবার এক বিশেষ দৈনন্দিন রজনামচা ছিল — ভোর চারটা, সাড়ে চারটায় ওঠা, অনেকটা হেঁটে মন্দির ভ্রমণ করা, তারপর নিজের ছোট দোকানে যাওয়া। তিনি স্থানীয় কারিগরের বানানো চামড়ার জুতো পরতেন, হাঁটার সময় “টুক টুক টুক” শব্দ হত। গ্রামবাসীরা বলতেন, তাঁরা তাদের ঘড়ি মেলাতেন দামোদর ভাইয়ের আসার সময়, কারণ তিনি ছিলেন সময়নিষ্ঠ ও নিয়মানুবর্তী। তিনি গভীর রাত অবধি কাজ করতেন। মা নিশ্চিত করতেন যাতে আমরা অভাব বোধ না করি, যতই কষ্ট হোক না কেন।


আমার মা অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি বাড়ির খুঁটিনাটি কাজ করতেন, পাশাপাশি অন্যের বাড়িতেও কাজ করতেন। তিনি কখনো আমাদের অভাব বুঝতে দেননি। আমার পরিবারে স্নেহ-ভালোবাসার অভাব ছিল না। আমরা ভাইবোনেরা একে অপরকে সাহায্য করতাম। আর্থিক ক্ষমতা সীমিত ছিল, কিন্তু মানসিকভাবে খুব সমৃদ্ধ ছিলাম।

আমার শৈশবে বড় প্রভাব ফেলেছিল ভদনগরের পরিবেশ। ক্ষুদ্র জগৎ, কিন্তু ভেতরে ছিল বৈচিত্র্য ও প্রাণশক্তি। হিন্দু, মুসলমান, জৈন সবাই একসঙ্গে বাস করত। উৎসব, মেলা, যাত্রা আমাদের জীবনের অংশ ছিল। ছোটবেলায় আমি এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। আমি নাটক করতাম, রামলীলা মঞ্চে অভিনয় করতাম। এসব অভিজ্ঞতা আমাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রেলস্টেশন। আমাদের বাড়ি ছিল রেলস্টেশনের কাছাকাছি। আমার বাবা সেখানে চা বিক্রি করতেন, আমিও ছোটবেলায় বাবাকে সাহায্য করতাম। সারা দেশ থেকে মানুষ আসত, নানা ভাষায় কথা বলত, নানা রকম পোশাক পরত। আমি তাদের দেখতাম, তাঁদের কথা শুনতাম, প্রশ্ন করতাম। খুব ছোটবেলায়ই আমার মধ্যে গোটা ভারতের প্রতি কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। আজ ভেবে দেখি, রেলস্টেশন ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়।

ভদনগরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। শিক্ষকরা ছিলেন সাধারণ, কিন্তু আন্তরিক। তাঁরা আমাদের শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়াননি, আমাদের চরিত্র গঠনে সাহায্য করেছেন। আমি স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। শৃঙ্খলা, দলবদ্ধতা, সমাজসেবার বীজ তখনই রোপিত হয়েছিল।

আমার মনে আছে, প্রায় ১৭-১৮ বছর বয়সে আমার ভেতরে এক প্রবল তাগিদ জাগল, আমি নিজের জীবনকে দেশের সেবায় উৎসর্গ করতে চাই। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি সংসার করব না, ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ রাখব না। আমার পথ হবে সন্ন্যাসের, সমাজের জন্য, মানুষের জন্য।

লেক্স ফ্রিডম্যান: তখনই কি আপনি হিমালয়ে গিয়েছিলেন?

প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ। কিশোর বয়সের সেই তাগিদ থেকেই আমি একদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরিবার কিছুটা অবাক হলেও জানত, আমি ছোট থেকেই একটু অন্যরকম। আমি হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলাম। কয়েক বছর ধরে উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি। ঋষিকেশ, হরিদ্বার, হিমালয়ের বিভিন্ন গুহা, আশ্রমে থেকেছি।

সেই সময়টাতে আমি গভীর ধ্যান - সাধনা করেছি। প্রকৃতির সঙ্গে থেকেছি। কখনো গুহায়, কখনো নদীর তীরে। অনেক সময় একাকীত্ব অনুভব হয়েছে, কিন্তু সেই একাকীত্বই আমাকে শক্তিশালী করেছে। আমি বই পড়েছি, দর্শন শিখেছি, নানা সাধু - সন্ন্যাসীর সঙ্গে থেকেছি।

আমার ভেতরে তখন বড় এক প্রশ্ন ছিল: “আমি কে? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী?” উত্তর খুঁজতে গিয়েই আত্ম - অনুসন্ধান শুরু করি। হিমালয়ে কাটানো সেই সময় আমাকে আজকের আমি হতে সাহায্য করেছে।

কিন্তু আমি কোনোদিনও স্থায়ীভাবে সন্ন্যাসী হইনি। আমার ভেতরে সবসময় একটা টান ছিল সমাজের সেবা করার। তাই কয়েক বছর পরে আমি ফিরে এলাম। ফিরে এসে আবার পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটালাম। তারপর আমি জনসংঘ (পরবর্তীতে ভারতীয় জনতা পার্টি) ও আরএসএস এর সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লাম। সেখানেই শৃঙ্খলাপূর্ণ সংগঠন, কঠোর পরিশ্রম, নিঃস্বার্থ সেবার শিক্ষা পেলাম।

লেক্স ফ্রিডম্যান: হিমালয়ে কাটানো দিনগুলো কি আপনার আজকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো প্রভাব ফেলে?

প্রধানমন্ত্রী: অবশ্যই। হিমালয় আমাকে শিখিয়েছে ধৈর্য। আমাকে শিখিয়েছে শুনতে। প্রকৃতির মাঝে বসে যখন আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করেন, তখন উপলব্ধি হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় আমরা কত ক্ষুদ্র। ক্ষমতা, পদ, অর্থ, সবই ক্ষণস্থায়ী। আসল আত্মা, আর মানুষের সেবা। আজও যখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আমি সেই অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকাই।


হিমালয় থেকে ফিরে আসার পর আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম, আমাকে সাধারণ মানুষের সেবার মধ্যে জীবন কাটাতে হবে। সেই সময় আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হই। আরএসএস আমাকে শৃঙ্খলা, সংগঠন চালানো ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শিখিয়েছে।

সেখান থেকে ধীরে ধীরে জনসংঘ ও পরে বিজেপির কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। আমি সাধারণ স্তরে কাজ করেছি, যেমন বুথ সংগঠিত করা, গ্রামের মানুষদের সমস্যা শোনা, সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া। আমি কখনোই ভাবিনি যে একদিন মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রী হব। আমার কাছে তখন মূল লক্ষ্য ছিল সমাজসেবা।

লেক্স ফ্রিডম্যান: কিন্তু অবশেষে আপনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

প্রধানমন্ত্রী: হঠাৎই দায়িত্ব আসে। আমি আগে কখনো প্রশাসনে কাজ করিনি। কিন্তু আমি এটাকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিলাম। আমার কাছে তখন একটাই প্রশ্ন ছিল, কীভাবে আমি আমার রাজ্যের মানুষের জীবনকে উন্নত করতে পারি?

আমি প্রশাসনের মধ্যে দলীয়তা নয়, উন্নয়নকে গুরুত্ব দিলাম। বিদ্যুৎ, রাস্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এই চার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনোযোগ দিলাম। কৃষকদের জন্য নতুন উদ্যোগ নিলাম। শিল্পে বিনিয়োগ আনতে চেষ্টা করলাম। “গুজরাট মডেল” তখন ধীরে ধীরে গড়ে উঠল।

সবচেয়ে বড় শিক্ষা, আপনার ইচ্ছাশক্তি ও মানুষের অংশগ্রহণ থাকলে সীমিত সম্পদ নিয়েও বড় পরিবর্তন আনা যায়।

লেক্স ফ্রিডম্যান: মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যাত্রা কতটা কঠিন ছিল?

প্রধানমন্ত্রী: আমি কখনো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজনীতি করিনি। ২০১৪ সালে দেশের মানুষ পরিবর্তন চাইছিলেন। তাঁরা একটি স্থিতিশীল সরকার, উন্নয়নমুখী সরকার চাইছিলেন। তখন বিজেপি আমাকে দায়িত্ব দিল। আর দেশের সাধারণ মানুষ আমাকে আশীর্বাদ করলেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমার প্রথম চিন্তা ছিল ভারতের মানুষকে কীভাবে আত্মবিশ্বাসী করা যায়। বহু দশক ধরে আমাদের মনে এক ধরনের হীনমন্যতা ঢুকে গিয়েছিল, “আমরা পারব না”, “আমরা পিছিয়ে আছি”। আমি চাইছিলাম সেই মানসিকতা ভাঙতে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আজ আপনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এটা কেমন অনুভূতি?

প্রধানমন্ত্রী: আমি যখন আন্তর্জাতিক বৈঠকে যাই, আমি নিজেকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখি না। আমি ভারতের ১৪০ কোটির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে দাঁড়াই। আমি চাই পৃথিবী বুঝুক, ভারত এখন কেবল ভোক্তা নয়, উদ্ভাবকও। ভারত সমস্যা নয়, সমাধান।

গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর কণ্ঠস্বর তোলার দায়িত্বও আমি ভারতের ওপর অনুভব করি। জলবায়ু পরিবর্তন, সুস্থায়ী উন্নয়ন, প্রযুক্তির গণতান্ত্রিক ব্যবহার, এসব ক্ষেত্রে ভারত নেতৃত্ব দিতে পারে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনার ব্যক্তিগত জীবনে এখনও কি আপনি সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমার ব্যক্তিগত জীবন খুবই সরল। আমি ভোগবিলাস করি না। আমার কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই, কোনো পরিবারিক দায়বদ্ধতাও নেই। আমার প্রতিটি মুহূর্ত দেশের জন্য। এটাই আমার সন্ন্যাস।

আমি এখনো ভোরে উঠে ধ্যান করি, যোগব্যায়াম করি। এগুলো আমাকে শারীরিক ও মানসিক শক্তি দেয়। রাজনীতির চাপ অনেক, কিন্তু এই অভ্যাসগুলো আমাকে স্থির থাকতে সাহায্য করে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি কীভাবে ভবিষ্যতের ভারতের স্বপ্ন দেখেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমি এক উন্নত ভারতের স্বপ্ন দেখি, “বিকসিত ভারত”।
একটা ভারত, যেখানে প্রতিটি পরিবার শিক্ষিত, সুস্থ, স্বনির্ভর। যেখানে প্রযুক্তি সবার জন্য সুযোগ তৈরি করবে। যেখানে নারী ও পুরুষ সমানভাবে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আমি চাই ভারত শুধু অর্থনীতিতে নয়, মানবিকতায়ও বিশ্বের শীর্ষে থাকুক। আমাদের প্রাচীন মূল্যবোধ “বসুধৈব কুটুম্বকম্” (সারা বিশ্ব এক পরিবার) হবে ২১শ শতকের দিশারী।

লেক্স ফ্রিডম্যান (উপসংহার): আপনার জীবনকাহিনি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। একটি ছোট শহরের চা বিক্রেতার ছেলে থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের নেতা হওয়া।

প্রধানমন্ত্রী: আমি বিশ্বাস করি—এটা কেবল আমার গল্প নয়, এটা ভারতের গল্প। ভারত এমন এক দেশ, যেখানে সাধারণ মানুষ থেকেও অসাধারণ কিছু করা সম্ভব। আমার জীবন তারই প্রমাণ।

লেক্স ফ্রিডম্যান: যারা হয়তো জানেন না, আপনি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে স্বামী আত্মস্থানন্দজির সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। যেমন আপনি বললেন, তিনি আপনাকে সেবামূলক জীবনের দিকে পরিচালিত করেছিলেন। এক সম্ভাব্য পথ ছিল সন্ন্যাস নেওয়া, সবকিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হওয়া। সেই ক্ষেত্রে আজ হয়তো আপনি এখানে সন্ন্যাসী নরেন্দ্র মোদি হিসেবে থাকতেন, অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। আপনার প্রতিটি স্তরে জীবনকে সেবার জন্য উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী: বাইরের দৃষ্টিতে মানুষ কাউকে নেতা, প্রধানমন্ত্রী, বা মুখ্যমন্ত্রী বলে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু আমার অন্তরের জীবন একটি অবিচ্ছিন্ন ধারা। যে মোদি ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে শিশুদের সেবা করত, যে মোদি তখন তাদের যত্ন নিত, যে মোদি হিমালয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, আর যে মোদি আজ এখানে দাঁড়িয়ে আছে—সব একই যাত্রার অংশ। আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অন্যদের জন্যই কাটানো হয়েছে। এই ধারাবাহিকতাই দুনিয়ার চোখে সাধু ও নেতার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। পার্থক্য কেবল পোশাকে, জীবনযাপনে, দৈনন্দিন ভাষায়, আর দায়িত্বে। কিন্তু ভেতরে আমি একই রকম অনাসক্তির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনার জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো "ভারত প্রথম" এর অটল প্রতিশ্রুতি। আট বছর বয়স থেকেই আপনি আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সমর্থন করে। আপনার আরএসএস-অভিজ্ঞতা আমাদের বলবেন? কীভাবে এটি আপনাকে প্রভাবিত করেছে এবং আপনার বিশ্বাস ও রাজনৈতিক দর্শনকে গঠন করেছে?

প্রধানমন্ত্রী: ছোটবেলা থেকেই আমি সব ধরনের কাজে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলাম। খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে—একজন মানুষ ছিলেন, নাম পুরো মনে নেই, সম্ভবত মাকোসি সোনি। তিনি সেবা দলে ছিলেন। তিনি একটি ঢোল (ডাফলি) নিয়ে দেশাত্মবোধক গান গাইতেন, তার অসাধারণ কণ্ঠস্বর ছিল। তিনি আমাদের গ্রামে আসতেন, বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করতেন। আমি তাকে অনুসরণ করতাম, সারারাত ধরে তার গান শুনতাম। এতে অদ্ভুত আনন্দ পেতাম, যদিও তখন বুঝতাম না কেন। একইভাবে, আমার বাড়ির কাছেই একটি আরএসএস শাখা ছিল, যেখানে আমরা খেলাধুলা করতাম, দেশাত্মবোধক গান গাইতাম। এই সবকিছু আমাকে গভীরভাবে টানত, আর সেখান থেকেই আমি সংঘের সঙ্গে যুক্ত হই।

আরএসএস আমাকে একটি মৌলিক শিক্ষা দিয়েছিল। যাই করো, দেশ সেবার মনোভাব নিয়ে করো। পড়াশোনা, শরীরচর্চা, যে কোনো কাজ, সবই হওয়া উচিত দেশের জন্য অবদান রাখার উদ্দেশ্যে। এই দর্শনই সংঘের শিক্ষায় নিহিত। আজ প্রায় এক শতাব্দী পূর্ণ করতে চলেছে আরএসএস, এবং এ রকম বিশাল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পৃথিবীতে আর নেই। কোটি কোটি সদস্য থাকলেও এর মর্ম পুরোপুরি বোঝা সহজ নয়। এর কাজ এবং উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করতে হয়, সেখান থেকেই একটি দৃঢ় দিকনির্দেশনা মেলে।

মূলত সংঘের দর্শন সবার আগে জাতি, আর জনসেবা মানেই ঈশ্বরসেবা। বৈদিক যুগ থেকে এই ভাবনা চলে আসছে, ঋষি মুনিরা এর কথা বলেছিলেন, নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ । একজন স্বয়ংসেবককে শেখানো হয় যে সংঘের সারমর্ম কেবল এক ঘণ্টার প্রার্থনা বা উর্দি পরা নয়। প্রকৃত স্বয়ংসেবা হলো সমাজের জন্য কিছু করা।

এই দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। যেমন, কিছু স্বয়ংসেবক সেবা ভারতী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যারা সেবা বসতিতে দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ায়—সরকারি সাহায্য ছাড়াই। সমাজের সহযোগিতায় তাঁরা শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মূল্যবোধ শেখানো, পরিচ্ছন্নতা অভিযান—এসব চালায়। আজ প্রায় ১.২৫ লক্ষ প্রকল্প চলছে। একইভাবে, কিছু স্বয়ংসেবক ভানবসি কল্যাণ আশ্রম শুরু করেছিলেন, যা বনাঞ্চলের আদিবাসীদের সেবা করে। তাঁরা ৭০,০০০ একল বিদ্যালয় (এক শিক্ষক, এক বিদ্যালয়) চালায়। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত সমর্থকরাও প্রতি মাসে ১০ বা ১৫ ডলার দান করেন, কখনো এক বোতল কোকা-কোলা না কিনে তার সমপরিমাণ অর্থ দান করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব আনার জন্য বিদ্যা ভারতী প্রতিষ্ঠা হয়। এখন তাঁরা প্রায় ২৫,০০০ বিদ্যালয় চালাচ্ছেন, যেখানে একসঙ্গে ৩০ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করছে। কোটি কোটি শিক্ষার্থী এর সুবিধা পেয়েছে। এখানে কেবল প্রথাগত শিক্ষা নয়, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ব্যবহারিক দক্ষতা, আর সামাজিক দায়িত্ববোধও শেখানো হয়।

আরএসএস নারী কল্যাণ, যুব উন্নয়ন, শ্রমিক অধিকার—সব ক্ষেত্রেই কাজ করেছে। ভারতীয় মজদুর সংঘ আজ বিশ্বের বৃহত্তম শ্রমিক সংগঠনগুলির একটি, প্রায় ৫৫,০০০ ইউনিয়ন এর সঙ্গে যুক্ত, কোটি কোটি শ্রমিক সদস্য। ইতিহাসে শ্রমিক আন্দোলন সাধারণত বামপন্থী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, যেখানে স্লোগান ছিল "পৃথিবীর স্রমজীবিরা ঐক্যবদ্ধ হন" কিন্তু আরএসএস-প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন তা পরিবর্তন করেছে। তাঁরা বলেন, "শ্রমজীবিরা পৃথিবীকে ঐক্যবদ্ধ করুন"। সামান্য পরিবর্তন, কিন্তু দর্শন বদলে দেয়। সংঘর্ষ নয়, ঐক্য ও সম্প্রীতি।

এইভাবে, সংঘের দর্শনে গড়ে ওঠা মানুষরা যেখানে গেছেন, সেখানেই পরিবর্তন এনেছেন। গত এক শতাব্দীতে আরএসএস আলোর আড়ালে থেকে অক্লান্ত সেবা করে এসেছে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। এমন এক মহান সংগঠন থেকে আমি মূল্যবোধ শিখেছি, যা আমার জীবনে লক্ষ্য এনে দিয়েছে। পরে আমি সাধু-সন্তদের সংস্পর্শে এসেছি, আধ্যাত্মিক জাগরণ অনুভব করেছি। স্বামী আত্মস্থানন্দজির মতো ব্যক্তিত্ব আমাকে প্রতিটি ধাপে দিশা দেখিয়েছেন, যেমন রামকৃষ্ণ মিশন এবং স্বামী বিবেকানন্দ কে শিক্ষা দিয়েছেন। সংঘের সেবামূলক দর্শন ও এই আধ্যাত্মিক প্রভাব একত্রে আমাকে গভীরভাবে গড়ে তুলেছে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আরএসএস শুধু মানুষকে গড়ে তোলেনি, ভারতের ধারণা কেও নতুন সংজ্ঞা প্রদান করেছে। আপনার মতে, কী সেই মৌলিক ধারণা যা ভারতকে একত্রিত করে? সমাজ, সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, এত বৈচিত্র্যের মাঝেও ভারতের আসল সত্তা কী?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, ভারত একটি একক জাতি, যার সাংস্কৃতিক পরিচয় হাজার বছরের সভ্যতাকে ধারণ করে। ভারতের শতাধিক ভাষা, হাজারো উপভাষা। বলা হয়, বিশ কিলোমিটার গেলেই ভাষা, রীতি, খাবার, পোশাক বদলে যায়। দক্ষিণ থেকে উত্তর, যেদিকেই তাকান, বৈচিত্র্য চোখে পড়বে। কিন্তু ভেতরে দেখুন, একটি সূত্র সবকিছুকে বেঁধে রেখেছে।

আমি প্রায়ই বলি, রাম নাম সারা দেশে অনুরণিত হয়। তামিলনাড়ু থেকে জম্মু - কাশ্মীর, যেখানেই যান, মানুষের নামের মধ্যে ‘রাম’ থাকবে। গুজরাতে ‘রামভাই’, তামিলে ‘রামচন্দ্রন’, মহারাষ্ট্রে ‘রামভাউ’। এটাই সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রমাণ।

অথবা স্নানের উদাহরণ নিন। লোকেরা বালতিতে জল নিয়ে স্নান করেন, কিন্তু মনে মনে তাঁরা দেশের বিভিন্ন নদীর নাম জপ করেন। সেই প্রার্থনা, “গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী, নর্মদা সিন্ধু কাবেরী জলে’স্মিন সন্নিধিং কুরু”, মানে একসঙ্গে সব নদীর জলে স্নান করা হলো, সারা দেশকে ধারণ করা হলো।

আমাদের এক গভীর প্রথা আছে। সংকল্প। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের আগে সংকল্প নেওয়া হয়। বিয়ে হোক, যজ্ঞ হোক, সবকিছুর আগে আমরা মহাবিশ্ব, তারপর জম্ভুদ্বীপ, তারপর ভারতখণ্ড, আর্যাবর্ত, শেষে গ্রাম ও পরিবারদেবতার নাম উচ্চারণ করি। এই ধারাই আমাদের ঐক্যের শক্তি।

শ্বাসন ব্যবস্থা তো নানা রকম এসেছে। রাজা, সম্রাট, ছোট রাজ্য, ভাঙা রাজ্য। কিন্তু ভারতকে ধরে রেখেছে সাংস্কৃতিক ঐক্য। তীর্থযাত্রা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আদি শঙ্করাচার্য চারধাম স্থাপন করেছিলেন, সারা দেশে আধ্যাত্মিক ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। আজও লাখ লাখ মানুষ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তীর্থযাত্রা করে।

লোকেরা কাশীতে যায়, আবার রামেশ্বরম থেকে কাশীতে গঙ্গাজল নিয়ে যায়, উল্টো দিকেও। এ ধরনের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রথাই দেশকে একত্রে বেঁধে রেখেছে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আধুনিক ভারতের ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী ও আপনি দুজনই বিশাল প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। আপনি গান্ধীজির কোন গুণকে সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমি গুজরাটে জন্মেছি, আমার মাতৃভাষা গুজরাটি। গান্ধীজিও গুজরাটের, একই সাংস্কৃতিক শিকড়ে বড় হয়েছিলেন। তিনি ব্যারিস্টার হয়েছিলেন, বিদেশে থেকেছেন, নানা সুযোগ তার সামনে ছিল, কিন্তু তিনি পরিবারের থেকে শেখা মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরেছিলেন। ভোগবিলাস ছেড়ে তিনি দেশসেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।

তাঁর বড় গুণ ছিল, তিনি যা প্রচার করতেন নিজে পালন করতেন। পরিচ্ছন্নতার কথা বলতেন, আবার নিজে ঝাঁট দিতেন, অন্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন। ভারতের স্বাধীনতার লড়াই অনন্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী বিদেশি শাসনে থেকেও কোথাও প্রতিরোধের আগুন নিভে যায়নি। অসংখ্য বিপ্লবী প্রাণ দিয়েছেন।

গান্ধীজির স্বাধীনতার আন্দোলনকে গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি বলতেন, ঝাঁট দিচ্ছেন? স্বাধীনতার জন্য দিচ্ছেন। খদ্দর বুনছেন? স্বাধীনতার জন্য। এমনকি লবণকেও তিনি প্রতীকে রূপান্তরিত করলেন। ডান্ডি মার্চ।

তাঁর সারল্য, তাঁর রসবোধ অনন্য। যেমন, বাকিংহাম প্যালেসে ধুতি পরে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মহারাজ দুজনের জন্য পর্যাপ্ত কাপড় পরে আছেন।”

আমার কাছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা, জনগণের শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। সরকার একা কিছু করতে পারে না, সমাজের সম্মিলিত শক্তিই আসল।

 

লেক্স ফ্রিডম্যান: গান্ধী ছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নেতা, আর আপনাকে একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় নেতা বলা হয়। আপনার ক্ষেত্রে, ভালোবাসা পাওয়া ভালো নাকি ভীতির সম্মান?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমত, আমি এ ধরনের তুলনাকে ঠিক মনে করি না। ২০তম, ২১তম বা ২২তম শতাব্দী নয়, গান্ধীজি চিরকালীন। আর আমার শক্তি মোদির নয়, ১৪০ কোটি ভারতীয়ের মধ্যে, হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে। আমি কোথাও ব্যক্তিগতভাবে যাই না। দেশের প্রতিনিধি হিসেবে যাই।

২০১৩ সালে যখন আমাকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করা হয়, অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন—এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আন্তর্জাতিক কূটনীতি সামলাতে পারবেন? আমি বলেছিলাম—“ভারত কারও সামনে মাথা নত করবে না, কারও দিকে নিচু চোখে তাকাবে না। সমান মর্যাদায় সবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে।” আজও সেটাই আমার নীতি।

আমাদের সংস্কৃতি কাউকে অপমান করা শেখায় না। আমরা সবসময় "বসুধৈব কুটুম্বকম্" মন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি তাই বলেছিলাম, এক সূর্য, এক পৃথিবী, এক সূত্র। পৃথিবী আজ আন্তঃনির্ভরশীল, সহযোগিতা ছাড়া চলবে না।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি বলেছেন বিশ্বশান্তির জন্য আপনার অভিজ্ঞতা ও প্রভাব কাজে লাগাতে চান। আজকের রাশিয়া – ইউক্রেন এর মত নানা সংঘাতে যুদ্ধবিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য আপনি কিভাবে এগোবেন?

প্রধানমন্ত্রী: আমি বুদ্ধের ভূমির প্রতিনিধি। আমি গান্ধীর ভূমির প্রতিনিধি। তাঁদের শিক্ষা, জীবন, সবই শান্তির জন্য উৎসর্গিত। তাই যখন ভারত শান্তির কথা বলে, পৃথিবী মনোযোগ দিয়ে শোনে।

আমরা সংঘাত চাই না। প্রকৃতির সঙ্গে নয়, জাতির সঙ্গে নয়। আমরা চাই সমন্বয় ও সহযোগিতা। তাই যদি কিছু অবদান রাখতে পারি, সর্বদা চেষ্টা করি।

আমার রাশিয়া ও ইউক্রেন, দুই দেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমি রাষ্ট্রপতি পুতিনকে বলেছি, এ সময় যুদ্ধের নয়। রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি কেও বলেছি “যত সমর্থনই পাও, যুদ্ধ থেকে সমাধান আসে না, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসে।”

এখন ধীরে ধীরে সবাই উপলব্ধি করছে, দু’দেশই অনেক ক্ষতি সহ্য করেছে। খাদ্য, জ্বালানি, সার সংকটে সমগ্র বিশ্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। তাই আজ সবাই শান্তি চায়। আমি পরিষ্কারভাবে বলেছি, আমি নিরপেক্ষ নই, আমার পক্ষ শান্তি। আমি তার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আরেকটি ঐতিহাসিকভাবে জটিল এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক সংঘাত হলো ভারত এবং পাকিস্তানের।  দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর এবং তাদের আদর্শগত পার্থক্য গভীর। আপনি একজন প্রগতিশীল নেতা যিনি শান্তি চান। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব ও পুনর্মিলনের জন্য আপনি কোন পথে এগোনো সম্ভব বলে মনে করেন?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমত, কিছু ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে যা বিশ্ববাসীর অনেকেই জানেন না। ১৯৪৭ সালের আগে, ভারতের সমস্ত ধর্মের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে একসাথে লড়াই করেছিলেন। সমগ্র দেশ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত। তবে বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতির কারণে তখনকার নীতিনির্ধারকরা ভারতের বিভাজনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, যদি কিছু মুসলিম আলাদা দেশ চায়, তাহলে তাদের সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। ভারতের জনগণ এই সিদ্ধান্তটি ভারাক্রান্ত মনে গ্রহণ করেছিল এবং অসীম কষ্ট সহ্য করেছিল। তবে, বিভাজনের গ্রহণ পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী দুঃস্বপ্নের সৃষ্টি করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল, এবং পাকিস্তান থেকে আসা ট্রেনগুলো নিরীহ মানুষের দেহে ভরা থাকত। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। পাকিস্তান যখন তার নিজস্ব ভূমি লাভ করেছিল, তখন কৃতজ্ঞতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থাপনের প্রতিশ্রুতি আশা করা যেতে পারত। তবে শান্তির পরিবর্তে পাকিস্তান ভারতের প্রতি চিরস্থায়ী শত্রুতার পথ বেছে নিয়েছে। আজও একটি প্রক্সি যুদ্ধ চলছে। এটি আদর্শের বিষয় নয়। কোনো আদর্শও নিরীহ মানুষ হত্যার কথা বলে না। তবুও পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাস রপ্তানি করছে। এবং এটি শুধুমাত্র ভারতের ক্ষেত্রে নয়। বিশ্বের যেকোনো স্থানে সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে প্রায়ই পাকিস্তানের দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার কথা ভাবুন। পরিকল্পনাকারী ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে লুকিয়ে ছিল। এখন বিশ্ব পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি কেবল ভারতের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যও সমস্যার উৎস হয়ে উঠেছে। আমরা বারবার পাকিস্তানকে এই ধ্বংসাত্মক পথে না চলার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা তাদের বলেছি যে রাষ্ট্র - সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ শেষ করতে হবে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ায় কারোরই লাভ হয় না। শান্তির চেষ্টায় আমি ব্যক্তিগতভাবে লাহোরে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আমি পাকিস্তানকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম একটি শুভ সূচনা কামনা করে। তবে শান্তির প্রতি প্রতিটি প্রকৃত প্রচেষ্টা শত্রুতার মুখোমুখি হয়েছে। আমরা শুধুমাত্র আশা করতে পারি যে সুবুদ্ধি প্রাধান্য পাবে এবং পাকিস্তান শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ বেছে নেবে। আমি বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এই অন্তহীন হিংসার চক্রে ক্লান্ত। কোনো নাগরিক প্রতিদিন রক্তপাত দেখতে চায় না। সীমান্তে সন্ত্রাসীরা নিজেদের জীবন হারায়, এবং তাদের পরিবার কষ্টভোগ করে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: এমন কি কোনো বিশেষ উদাহরণ আছে যেখানে আপনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে প্রচেষ্টা করেছেন? এমন কোনো গল্প যা ভবিষ্যতের শান্তির জন্য পথ প্রদর্শক হতে পারে?

প্রধানমন্ত্রী: সম্পর্ক উন্নয়নের প্রথম বড় পদক্ষেপ ছিল আমি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তান কে আমন্ত্রণ জানান। এটি নিজেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ২০১৩ সালে অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন মোদির বিদেশ নীতি কেমন হবে, এবং আমি সমস্ত সার্ক দেশের নেতাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছি জেনে তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন । এই সিদ্ধান্তের কথা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার স্মৃতিকথায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। এটি ভারতের বিদেশ নীতির স্বচ্ছতা, আত্মবিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছিল। এটি বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের শান্তির প্রতি প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে। তবে এই উদ্যোগের তাৎপর্য সত্ত্বেও প্রত্যাশিত ফলাফল হয়নি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনার জন্য একটি হালকা প্রশ্ন। আপনার মতে কোন ক্রিকেট দল ভালো, ভারত না পাকিস্তান? মাঠে এবং ভূ-রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ প্রবাদপ্রতিম, যেমন আপনি সম্প্রতি আলোচনা করেছেন। ক্রীড়া, বিশেষ করে ক্রিকেট এবং ফুটবল, কীভাবে দেশের মধ্যে সম্পর্ক এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করে?

প্রধানমন্ত্রী: ক্রীড়া সমগ্র বিশ্বের জন্য শক্তির উৎস। ক্রীড়াবিদদের মনোভাব মানুষকে একত্রিত করার শক্তি বহন করে। আমি চাই না ক্রীড়াকে বাহ্যিক প্রভাব কলঙ্কিত করুক। আমি সবসময় ক্রীড়াকে মানব উন্নয়ন এবং অগ্রগতির একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছি। কোন দল শক্তিশালী তা বিচার করার বিশেষজ্ঞ আমি নই, তাই সেটি যারা জানে তাদের উপর ছেড়ে দেওয়াই শ্রেয়। তবে, ফলাফল কথা বলে। সম্প্রতি, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটি ম্যাচ হয়েছিল। সেই ম্যাচের ফলাফল স্পষ্টভাবে দেখায় কোন দল বর্তমানে শক্তিশালী।

লেক্স ফ্রিডম্যান: হ্যাঁ, সম্প্রতি আমি একটি সিরিজ দেখেছিলাম যার নাম দা গ্রেটেস্ট রাইভালরি – ইন্ডিয়া ভারসেস পাকিস্তান। কিছু অসাধারণ খেলোয়াড় এবং ম্যাচকে উল্লেখ করা হয়ছে এই সিরিজে। এত তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা সত্যিই মজার। আপনি ফুটবলও উল্লেখ করেছেন। ফুটবল ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাহলে একটি কঠিন প্রশ্ন। আপনার প্রিয় ফুটবলার কে? মেসি, পেলে, মারাদোনা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, বা জিদান - আপনার মতে, সবার সেরা ফুটবলার কে?

প্রধানমন্ত্রী: ভারতে অনেক অঞ্চলে ফুটবল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়, এবং আমাদের নারী ও পুরুষ দলের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা গেছে। অতীতে, বিশেষ করে ১৯৮০ এর দশকে, মারাদোনার নাম প্রায়ই প্রথমে আসে। তিনি সেই প্রজন্মের নায়ক। তবে আজকের যুব ফুটবলপ্রেমীরা প্রায়শই মেসিকেই তাদের আইকন মনে করে। আপনার প্রশ্ন আমাকে একটি আকর্ষণীয় ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিল। মধ্য ভারতের মধ্যপ্রদেশের শাহদোল নামে একটি জেলা আছে। এখানে প্রধানত উপজাতি জনগোষ্ঠী বাস করে। আমি উপজাতি মহিলাদের পরিচালিত স্ব উদ্যোগী দল গুলির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি, কারণ এই সম্পর্কগুলি আমাকে গভীরভাবে সমৃদ্ধ করে। একবার সেখানে যাওয়ার সময়, আমি প্রায় ৮০ থেকে ১০০ জন যুবককে স্পোর্টস ইউনিফর্মে দেখেছিলাম। কিছু শিশু, কিছু কিশোর, এবং কয়েকজন প্রাপ্তবয়স্ক। স্বাভাবিকভাবেই, আমি কৌতূহলী হয়ে তাদের কাছে গিয়েছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তোমরা সবাই কোথা থেকে এসেছ?" তাঁরা উত্তর দিল, "আমরা মিনি ব্রেজিল থেকে এসেছি।" আমি অবাক হয়ে আরও জানতে চাই, "মিনি ব্রেজিল মানে কী?" তাঁরা ব্যাখ্যা করলো, চার প্রজন্ম ধরে সেখানে ফুটবল খেলা হচ্ছে বলে তাদের গ্রামকে এই নাম দেওয়া হয়েছে। গ্রামটি প্রায় ৮০ জন জাতীয় স্তরের খেলোয়াড় দিয়েছে। পুরো সম্প্রদায় খেলাধুলার প্রতি উৎসাহী। তাঁরা আমাকে বলেছিল বার্ষিক ফুটবল ম্যাচ চলাকালীন ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ দর্শক আশেপাশের গ্রাম থেকে আসে। এই গল্প ভারতের ফুটবল প্রেমকে প্রতিফলিত করে। আমার কাছে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। ফুটবল দলবদ্ধতা এবং সৌহার্দ্য বাড়ায়।

লেক্স ফ্রিডম্যান: নিঃসন্দেহে। ফুটবল শুধু ভারতে নয়, বিশ্বজুড়ে মানুষকে একত্রিত করে। এটি খেলাধুলার মানুষকে একত্রিত করার শক্তি প্রদর্শন করে। সম্প্রতি আপনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব পুনরুজ্জীবিত করেছেন। বন্ধু এবং নেতা হিসাবে তার কোন গুণের আপনি প্রশংসা করেন?

প্রধানমন্ত্রী: কেবল আমার মতামত প্রকাশ একটা ছোট গল্প বলি। হিউস্টনে হাউডি মোদী অনুষ্ঠানে দুজনেই উপস্থিত ছিলাম। স্টেডিয়ামটি ভর্তি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য একটি অসাধারণ দৃশ্য। ভারতীয় প্রবাসীরা বড় সংখ্যায় জড়ো হয়েছিলেন। আমরা দুজনই ভাষণ দিয়েছিলাম। আমি যখন বক্তব্য রাখছিলাম, রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। আমি তাঁর বিনয় দেখে মুগ্ধ হই। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির শ্রোতাদের মাঝে বসে আমার বক্তৃতা শোনা — এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। বক্তব্য শেষ করার পর, আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর নিরাপত্তা এবং বিস্তৃত নিয়ম থাকার কারণে আমি এক মুহূর্তের জন্য দ্বিধায় ছিলাম, তবে পরে প্রস্তাব দিলাম, "আপনি কি আমার সঙ্গে স্টেডিয়ামের চারপাশে হাঁটবেন?" সেখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন, অনেকেই হাত তুলেছিল, 'নমস্তে' করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে একজন বর্তমান রাষ্ট্রপতি কে ওরকম বিশাল জনতার মধ্যে স্বাধীনভাবে হাঁটানো প্রায় অসম্ভব। তবুও, ট্রাম্প বিনা দ্বিধায় সম্মতি দিয়েছিলেন। তিনি সাধারণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ উপেক্ষা করে আমার সঙ্গে হাঁটলেন। মার্কিন নিরাপত্তা কর্মীরা দৃশ্যত বিস্মিত হয়েছিল। আমি তখন বুঝতে পারি ভদ্রলোক কতটা সাহসী। তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন। এবং, গুরুত্বপূর্ণভাবে, তিনি আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। তাঁর যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল যে, আমি জনতার মধ্যে বিনা দ্বিধায় হাঁটতে পারব। এই পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়া আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করেছে। পরে, যখন তিনি সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচারণার সময় গুলিবিদ্ধ হন, আমি একই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দেখেছি—একই দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তি। তিনি বেঁচে থাকেন, এবং তাঁর আমেরিকার প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি অক্ষুণ্ণ থাকে। আমি 'নেসান ফার্স্ট' ব্যক্তি। তিনি বলেন, 'আমেরিকা ফার্স্ট'। আমি 'ভারত ফার্স্ট'। এ কারণেই আমরা এত ভালভাবে সংযুক্ত। এই নীতি আমাদের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়।

লেক্স ফ্রিডম্যান: সম্প্রতি আপনার সফরে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, আপনি তাঁর চেয়ে ভালো এবং বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একজন আলোচক ও কৌশলবিদ। আপনি কৌশলবিদ হিসাবে তাঁর সম্পর্কে কী মনে করেন? এবং তিনি যখন বলেছিলেন যে আপনি আলোচনায় পারদর্শী, তখন তার মানে কী?

প্রধানমন্ত্রী: আমি এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারব না, কারণ এটি তাঁর উদারতা যে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ্যে আমাকে প্রশংসা করেছেন। তবে, একটি বিষয় নিশ্চিত —  আমি সবসময় দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখি। এ কারণেই আমি প্রতিটি মঞ্চে ভারতের স্বার্থের পক্ষে সর্বদা অবস্থান নিই। আমি এটি কারও ক্ষতি করতে নয়, বরং গঠনমূলকভাবে করি, যাতে কেউ আপত্তি না করে। সবাই বোঝে যে, যদি মোদি উপস্থিত থাকেন, তিনি দৃঢ়ভাবে এই নীতিগুলোর প্রতি নিষ্ঠ থাকবেন। আমার দেশের মানুষ আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি সর্বদা তাঁদের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করব।

লেক্স ফ্রিডম্যান: যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়, আপনি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন, যেমন এলন মাস্ক, জেডি ভ্যান্স, তুলসি গাব্বার্ড, এবং বিবেক রামাস্বামী। এই বৈঠকগুলির মূল বিষয়বস্তু কী ছিল? কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বা স্মরণীয় মুহূর্ত ঘটেছিল কি?

প্রধানমন্ত্রী: আমি বলতে পারি যে আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তার প্রথম এবং এখন দ্বিতীয় মেয়াদে পর্যবেক্ষণ করেছি। এইবার তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে আরও প্রস্তুত। তাঁর কাছে একটি সুসংগঠিত রোডম্যাপ এবং স্পষ্ট কৌশল রয়েছে। আমি তার দলের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেয়েছি, এবং আমি বলতে চাই, তিনি অত্যন্ত দক্ষ দল গঠন করেছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার কথোপকথন থেকে আমি বুঝতে পেরেছি যে তাঁরা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে প্রস্তুত। যাদের সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করেছি— সেটা তুলসি জি, বিবেক জি, বা এলন মাস্ক হোক—সেখানে একটি উষ্ণ, প্রায় পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের সঙ্গে এসেছিলেন। আমি এলন মাস্ককে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই চিনি। তিনি তার পরিবার এবং সন্তানদের সঙ্গে আসায় সমাবেশ আরও অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং আকর্ষণীয় হয় উঠেছিল। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের আলোচনা বিভিন্ন বিষয় হয়।  বর্তমানে, তিনি তার মহাকাশ মিশনে গভীরভাবে বিনিয়োগ করছেন, এবং তাদের অগ্রগতির বিষয়ে তার উদ্দীপনা স্পষ্ট। এটি আমার জন্য সমানভাবে আনন্দদায়ক ছিল, কারণ আমি ও ২০১৪ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমার দেশকে পুরনো ব্যবস্থাপনা ও অকার্যকর প্রথা থেকে মুক্ত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। উদাহরণস্বরূপ, যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম, আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে বিভিন্ন সরকারি কল্যাণ সুবিধা এমন ব্যক্তিরা দাবি করছে যাদের অস্তিত্বই নেই—মিথ্যা পরিচয় যা জালভাবে নিবন্ধিত ছিল। এই কাল্পনিক সুবিধাভোগীরা "বিবাহিত হবে", "বিধবা হবে" এবং পেনশন গ্রহণ শুরু করবে, অথবা মিথ্যা প্রতিবন্ধিতা সুবিধা দাবি করবে। আমি একটি বিস্তৃত যাচাই প্রক্রিয়া চালু করেছিলাম এবং সিস্টেম থেকে প্রায় ১০ কোটি (১০০ মিলিয়ন) জাল বা নকল সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে বাদ দিয়েছি। এই ক্লিন-আপ থেকে সঞ্চিত অর্থ সরাসরি প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (ডি বি টি) এর মাধ্যমে পৌঁছানো হয়েছে। এটি নিশ্চিত করেছে যে দিল্লিতে অনুমোদিত প্রতিটি টাকা কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়া ঠিক প্রাপক পর্যন্ত পৌঁছায়। শুধুমাত্র এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমার দেশ প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা সঞ্চয় করেছে, যা পূর্বে দুর্নীতির মাধ্যমে অপচয় হত। এছাড়াও, আমি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অকার্যকারিতা দূর করতে ব্যাপকভাবে কাজ করেছি। আমি জি ই এম পোর্টাল চালু করেছি, যা সরকারি ক্রয়ের জন্য একটি ই-মার্কেটপ্লেস, এবং এটি ব্যয় হ্রাস, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, এবং উচ্চমানের ক্রয় নিশ্চিত করেছে। আরেকটি বড় উদ্যোগ ছিল আমলাতন্ত্রের হ্রাস। ভারতে অসংখ্য নিয়ন্ত্রক নিয়মাবলী ছিল, অনেকগুলো পুরনো এবং অচল। আমি ৪০,০০০টি এই ধরনের নিয়ম বাতিল করেছি এবং প্রায় ১,৫০০টি পুরনো আইন খারিজ করেছি। এর মাধ্যমে আমি সরকারকে অকার্যকর প্রক্রিয়াগুলির বোঝা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছি। এই রকম পরিবর্তনমূলক উদ্যোগ আমরা প্রয়োগ করছি, এবং স্বাভাবিকভাবেই, এ ধরনের বিষয়গুলি আলোচনা চলাকালীন উঠে আসে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। এই বন্ধুত্বকে কীভাবে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে যাতে সাম্প্রতিক উদ্বেগ কমে এবং ভারত ও চীনের মধ্যে পুনরায় সংলাপ ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, ভারত এবং চীনের সম্পর্ক ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। উভয়ই প্রাচীন সভ্যতা এবং আধুনিক বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি রয়েছে। ইতিহাসের নথি দেখলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারত ও চীন একে অপরের কাছ থেকে শিখেছে এবং বিশ্বজনীন অগ্রগতিতে যৌথ অবদান রেখেছে। এমন সময় ছিল যখন ভারত এবং চীন যৌথভাবে বিশ্ববের জি ডি পির ৫০%-এর বেশি দখল করত, যা তাদের বিশাল প্রভাবকে নির্দেশ করে। ভারতের অবদান এত বড় ছিল। আমাদের দেশের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই শক্তিশালী ছিল, গভীর সাংস্কৃতিক সংযোগসহ, এবং ঐতিহাসিকভাবে আমাদের মধ্যে কোনো সংঘাতের রেকর্ড নেই। বরং, পারস্পরিক শিক্ষা ও বিনিময়ের মনোভাব ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের বৌদ্ধধর্মের চীনে প্রভাব গভীর ছিল। সামনে তাকালে, আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা এই শক্তিশালী সম্পর্ককে বজায় রাখি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মতবিরোধ অবশ্যম্ভাবী—এটি কেবল কূটনৈতিক বাস্তবতা নয়, এমনকি পরিবারগুলিতেও ঘটে। তবে আমরা চেষ্টা করি যাতে এই ভিন্নতা বিবাদে রূপ না নেয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বিরোধের উপর সংলাপকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কারণ স্থিতিশীলতা এবং সহযোগিতা উভয় দেশের স্বার্থে। সত্য যে আমাদের সীমান্ত বিতর্ক চলমান। ২০২০ সালের ঘটনাগুলি আমাদের সম্পর্ককে উল্লেখযোগ্য চাপ দিয়েছিল। তবে, আমার সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে বৈঠকের পরে আমরা সীমান্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে দেখেছি, এবং ধাপে ধাপে ২০২০-এর পূর্বের অবস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য কাজ করছি। বিশ্বাস পুনর্নির্মাণ এবং সহযোগিতার মনোভাব পুনর্জীবিত করতে সময় লাগবে, বিশেষত সক্রিয় সংলাপের পাঁচ বছরের ফাঁকের পর। তবে, আমাদের অংশীদারিত্ব কেবল লাভজনক নয়, বরং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ২১ শতাব্দী—যাকে প্রায়ই "এশিয়ার শতাব্দী" বলা হয়—ভারত এবং চীনের মধ্যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়, তবে সংঘাত নয়।

লেক্স ফ্রিডম্যান: বিশ্বজুড়ে বড় যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা, ইউক্রেন ও রাশিয়ার চলমান সংঘাত, ইউরোপে অশান্তি, এবং মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুতা—সবই এই উত্তেজনা বাড়ায়। আপনার দৃষ্টিতে, ২১ শতাব্দীতে বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে কী করা যেতে পারে? কীভাবে সংঘাতের আরও বৃদ্ধি এড়ানো যায়?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, কোভিড ১৯ অতিমহামারী সমস্ত দেশের দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে। যেকোনো দেশ যতই শক্তিশালী, প্রগতিশীল বা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত মনে করুক না কেন, মহামারী সবার জন্যই শিক্ষণীয় প্রমাণিত হয়েছে। এটি সমগ্র বিশ্বকে প্রান্তে নিয়ে এসেছে। অল্প সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল, বিশ্বের মানুষ এই সংকট থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেবে এবং নতুন, সহযোগিতামূলক বিশ্বব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হবে—যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন বিশ্বব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, শান্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে, বিশ্ব অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত হয়েছে। সংঘাত বেড়েছে, এবং ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ গুরুতর হয়েছে। আধুনিক যুদ্ধ শুধুমাত্র সম্পদ বা আঞ্চলিক সম্প্রসারণের বিষয় নয়। আজ সংঘাতের বিভিন্ন রূপ রয়েছে— সরাসরি যুদ্ধের পাশাপাশি আদর্শগত এবং অর্থনৈতিক লড়াইও। এদিকে শান্তি বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্যহীন হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলিতে খুব কম বা কোনো কার্যকর সংস্কার হয়নি। অনেক বিশ্বশক্তি আন্তর্জাতিক আইন ও নিয়মাবলী উপেক্ষা করছে, এবং তাদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই। এই চ্যালেঞ্জগুলির প্রেক্ষিতে, বিশ্বের বুঝতে হবে যে সংঘাতের পথ শুধুই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। পরিবর্তে, আমাদের সহযোগিতা ও সমন্বয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সম্প্রসারণবাদী আকাঙ্ক্ষা ইতিবাচক ফল দেয় না; কেবল উন্নয়নমুখী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতিই ফলপ্রসূ। আমরা গভীর আন্তঃনির্ভরতা ও সংযুক্তির যুগে বাস করি—কোনো দেশই বিচ্ছিন্নভাবে সফল হতে পারে না। প্রতিটি দেশের অন্যদের সমর্থন প্রয়োজন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বনেতারা উত্থিত সংঘাত নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সমাধানের প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আমি আশা করি, যত শীঘ্র সম্ভব, আমরা এই উত্তেজনার চক্র থেকে মুক্তি পাব এবং একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ বিশ্বের দিকে অগ্রসর হব।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি এখনও শিখছি।

প্রধানমন্ত্রী: তুমি ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছ।

লেক্স ফ্রিডম্যান: না, না, আমি এখনও শিখছি, প্রধানমন্ত্রী। আমি এখনো পারদর্শী নই। আপনার কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনে, আপনি ভারতের ইতিহাসের বহু কঠিন পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার একটি হলো ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা। এটি ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম কঠিন সময় ছিল, যখন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা ছড়ায়, যার ফলে হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। এটি সেই অঞ্চলের ধর্মীয় টানাপড়েনের প্রতিফলন। যেমন আপনি উল্লেখ করেছেন, তখন আপনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আমরা যদি সেই সময়ের কথা বলি, আপনি কি শিক্ষা নিয়েছেন? এছাড়াও উল্লেখ করতে চাই যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দু’বার—২০১২ এবং ২০২২ সালে— সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার সময় আপনার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে আমি জানতে চাই, সেই সময় থেকে আপনি সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী পেয়েছিলেন?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, আমি বুঝি, প্রথমে আপনি বললেন যে আপনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, আপনি এখনও শিখছেন কীভাবে সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়, এবং আপনার মনে কিছু দ্বিধা আছে। তবে আমি মনে করি, আপনি চেষ্টা করছেন, বিস্তৃত গবেষণা করেছেন এবং প্রতিটি বিষয় বিশদে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি মনে করি না আপনার জন্য কোনও কিছুই খুব কঠিন। আপনি যে পরিমাণ পডকাস্ট করেছেন, তা থেকে বুঝতে পারি যে আপনি ধারাবাহিকভাবে ভালো কাজ করছেন। এবং শুধুমাত্র মোদিকে প্রশ্ন করার পরিবর্তে, আমি মনে করি আপনি সত্যিই ভারতের পরিবেশ বোঝার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা করেছেন। এজন্য আমি মনে করি আপনার প্রচেষ্টা সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দেয়। আমি সত্যিই আপনার এই প্রচেষ্টা প্রশংসা করি এবং অভিনন্দন জানাই।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ধন্যবাদ।

প্রধানমন্ত্রী: অতীত ঘটনাগুলির প্রসঙ্গে, আপনি ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার উল্লেখ করেছেন। তবে তার আগে, আমি চাই ১২–১৫ মাসের একটি ছবি আপনাকে দেখাতে, যাতে পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বোঝা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে, তিন বছর আগে, কাঠমান্ডু থেকে দিল্লির একটি বিমান হাইজ্যাক করা হয় এবং আফগানিস্তানের কন্দহারে নিয়ে যাওয়া হয়। শত শত ভারতীয় যাত্রী বন্দি হয়। এটি ভারতের জন্য একটি বিশাল সংকট—জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। তারপর ২০০০ সালে, দিল্লিতে লাল কেল্লায় একটি সন্ত্রাসী হামলা হয়, যা পরিস্থিতিতে আরেকটি সংকট যোগ করে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে একটি বড় সন্ত্রাসী হামলা ঘটে, যা আবার বিশ্বকে আতঙ্কিত করে, কারণ এই ধরনের হামলার পরিকল্পনাকারীরা একই ধরনের। অক্টোবর ২০০১ সালে, জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় একটি সন্ত্রাসী হামলা হয়। ১৩ ডিসেম্বর ২০০১ সালে, ভারতীয় সংসদে হামলা হয়। এই ৮–১০ মাসের সময়কালটি দেখলে, আপনি দেখবেন বিশ্বজুড়ে ঘটনা, সন্ত্রাসী হামলা, রক্তপাত, এবং নিরীহ মানুষের মৃত্যু। এমন সময়ে, একটি ছোট ঘটনাও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, এবং এমন পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছিল। এই পরিবেশে, ৭ অক্টোবর ২০০১ সালে, হঠাৎ আমাকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিল পূর্বে ঘটে যাওয়া বৃহৎ ভূমিকম্পের পরে গুজরাট পুনর্বাসন। এটি পূর্বশতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প, যেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। হঠাৎ, এই দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আমার কাছে আসে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আমি শপথ নেয়ার দিন থেকেই এতে নিযুক্ত ছিলাম। আমি কখনও সরকারের অংশ ছিলাম না। আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি কখনও বিধায়ক হইনি। আমি কখনও কোনো নির্বাচনে লড়াই করিনি। প্রথমবারের মতো, আমাকে নির্বাচনে লড়তে হয়, এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে আমি বিধায়ক হয়েছি—একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি। প্রথমবার, ২৪, ২৫ বা ২৬ ফেব্রুয়ারি আমি গুজরাট বিধানসভার মঞ্চে প্রবেশ করি। তারপর, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে, বিধানসভার বাজেট সেশনে, আমরা হাউসে ছিলাম, যখন আমি মাত্র তিন দিন হলো বিধায়ক, তখন গোধরা ঘটনা ঘটে—একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা যেখানে মানুষ জীবিত দগ্ধ হয়। এখন কল্পনা করুন: পেছনে ছিল কন্দহার বিমান হাইজ্যাকিং, সংসদ হামলা, ৯/১১, এবং আরও অনেক ঘটনা, এবং হঠাৎ এই ভয়ঙ্কর ঘটনা যেখানে অনেক মানুষ দগ্ধ হয়। কল্পনা করতে পারেন পরিস্থিতি কেমন ছিল? অবশ্যই, কেউই সহিংসতা চায় না। সবাই শান্তি চায়। ২০০২ ছিল বৃহৎ দাঙ্গার সময়—এই দাবি একটি মিথ্যা ব্যাখ্যা। ২০০২-এর আগে, গুজরাট বহু দাঙ্গা দেখেছে। প্রায়ই কোথাও না কোথাও কারফিউ ছিল। এমনকি ক্ষুদ্র ঘটনা—যেমন ঘুড়ি লড়াই বা সাইকেল দুর্ঘটনা—ধর্মীয় সহিংসতার রূপ নিত। ২০০২-এর আগে, গুজরাটে ২৫০টিরও বেশি বড় দাঙ্গা ঘটেছিল। ১৯৬৯ সালে, গুজরাটে প্রায় ছয় মাসের মতো দাঙ্গা চলেছিল। তখন আমি রাজনৈতিক পরিসরে ছিলাম না—আমি সেই সময়ের কথা বলছি। ২০০২-এর ঘটনা একটি জ্বলন্ত বিন্দু হয়ে ওঠে, যা কিছু স্থানে সহিংসতার দিকে নিয়ে যায়। তবে, বিচারব্যবস্থা সবকিছু গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছে। তখনকার সরকারগুলো, আমাদের বিরোধী দলসহ, আমাকে দায়ী করতে চেয়েছিল। তাদের পুনরাবৃত্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বিচারব্যবস্থা সবকিছু বিশদে বিশ্লেষণ করেছে—দু’বারও—এবং আমরা সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছি। যারা অপরাধ করেছে, আদালতের মাধ্যমে তাদের শাস্তি হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: ২০০২-এর আগে, গুজরাট প্রায় প্রতি বছর দাঙ্গা দেখেছে। কিন্তু আজ, ২০২৫ সালে, গত ২০–২২ বছর গুজরাটে কোনো বড় দাঙ্গা হয়নি। সম্পূর্ণ শান্তি রয়েছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কখনও ভোটব্যাংক রাজনীতি নিয়ে নয়। আমরা "সবকা সাথে, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস" নীতি মেনে চলি। আমরা প্রতিপালন রাজনীতি থেকে সরে এসে আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি গ্রহণ করি। এ কারণেই সব পটভূমির মানুষ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গুজরাটকে প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধ রাজ্যে রূপান্তর করতে। এখন আমরা 'বিকশিত ভারত' অর্জনের দিকে কাজ করছি, এবং গুজরাট এই উদ্দেশ্যে অব্যাহতভাবে ভূমিকা রাখছে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: অনেক মানুষ আপনাকে ভালোবাসে—আমি এটি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি। তবে কিছু মানুষও আপনাকে সমালোচনা করে, বিশেষ করে মিডিয়ার সদস্যরা। মিডিয়া বিশেষভাবে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে আপনাকে সমালোচনা করেছে। আপনি সমালোচনার মোকাবিলা কীভাবে করেন? আপনার জীবনের যেকোনো পর্যায়ে, মিডিয়া বা অন্য কোথাও থেকে আসা সমালোচনার সঙ্গে আপনি কীভাবে আচরণ করেন?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, আপনি যা জিজ্ঞেস করেছেন—আমি সমালোচনার মোকাবিলা কীভাবে করি? যদি এক বাক্যে বলি, আমি এটি কে স্বাগত জানাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সমালোচনা হলো গণতন্ত্রের প্রাণ। যদি আপনি সত্যিই গণতান্ত্রিক হন, যদি গণতন্ত্র আপনার রক্তে থাকে, তবে যেমন আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে: "নিন্দক নিয়রে রাখি" (আপনার সমালোচকদের কাছে রাখুন)। সমালোচনা আপনাকে গণতান্ত্রিক, তথ্যভিত্তিক এবং কার্যকরভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। আমি মনে করি সমালোচনা হওয়া উচিত— বেশি হওয়া উচিত এবং তীক্ষ্ণ ও গভীর হওয়া উচিত। তবে আমার অভিযোগ হলো, আজকাল প্রকৃত সমালোচনা হয় না। প্রকৃত সমালোচনার জন্য গভীর অধ্যয়ন, বিশদ গবেষণা, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করা প্রয়োজন। আজ মানুষ শর্টকাট খোঁজে—তাঁরা পড়াশোনা করে না, গবেষণা করে না, দুর্বলতা খুঁজে বের করে অভিযোগ করার চেষ্টা করে না। অভিযোগ এবং সমালোচনার মধ্যে বড় পার্থক্য আছে। আপনি যেসব উল্লেখ করেছেন—সেগুলো অভিযোগ, সমালোচনা নয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে, আমাদের প্রকৃত সমালোচনা প্রয়োজন, ভিত্তিহীন অভিযোগ নয়। অভিযোগ কারো জন্যই উপকারে আসে না; এটি কেবল ক্ষুদ্র বিতর্ক তৈরি করে। এজন্য আমি সবসময় সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু যখন অভিযোগ মিথ্যা হয়, আমি শান্ত থাকি, স্থির থাকি, এবং দেশের সেবায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: হ্যাঁ, আপনি যা বলছেন তা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমি সত্যিই ভালো সাংবাদিকতাকে প্রশংসা করি। দুর্ভাগ্যবশত, আধুনিক সময়ে অনেক সাংবাদিক কেবল দ্রুত শিরোনাম পাওয়ার পেছনে ছুটছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, কারণ সেটাই তাঁদের পক্ষে সুবিধাজনক—চাঞ্চল্যকর শিরোনাম ও সস্তা জনপ্রিয়তা। আমি বিশ্বাস করি, একজন মহান সাংবাদিক হতে হলে ইচ্ছা আর তৃষ্ণা থাকতে হয়। এর জন্য গভীর বোধ ও পরিপূর্ণ গবেষণা লাগে। কতবার অগভীর রিপোর্টিং হয়, তা দেখে আমি দুঃখিত হই। এটাই প্রকৃতপক্ষে একটি কারণ, যার জন্য আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি না যে আমি এতে খুব পারদর্শী, কিন্তু এই কারণেই আমি আপনার সঙ্গে এই আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। মানুষ যথেষ্ট চেষ্টা করেন না; তাঁরা গভীরভাবে গবেষণা করেন না। আমি ঠিক জানি না, প্রস্তুতির জন্য কতগুলি বই আমি পড়েছি—শুধু বিষয়গুলো ঠিকভাবে অনুভব ও বোঝার চেষ্টা করেছি। এর জন্য প্রচুর প্রস্তুতি ও কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন। আমি চাই আরও অনেক প্রধান সাংবাদিকও একইভাবে কাজ করুন। এই ধরনের গভীর গবেষণা ও প্রচেষ্টা প্রকৃত সমালোচনা সম্ভব করে—শক্তিশালী ব্যক্তিদের, তাঁদের শক্তি, দুর্বলতা এবং ভুলগুলো গভীরভাবে তদন্ত করা যায়। কিন্তু এটি করতে প্রচুর প্রস্তুতি লাগে। আমি সত্যিই চাই আরও অনেক মহান সাংবাদিক এইভাবে কাজ করুন।

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, আমি ব্যাখ্যা করি। লক্ষ্যনীয় ও নির্দিষ্ট সমালোচনা প্রকৃতপক্ষে নীতিনির্ধারণে সাহায্য করে। এটি একটি স্পষ্ট নীতির দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। আমি এমন গঠনমূলক সমালোচনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিই এবং তা স্বাগত জানাই। এখন, আপনি সাংবাদিকতা ও শিরোনাম সম্পর্কে বলেছেন, আমি মনে করি কেউ যদি হেডলাইনের প্রতি আকর্ষণ রাখে বা শব্দচয়নে খেলতে চান, আমি সেটাকে খুব নেতিবাচকভাবে দেখি না। তবে, যখন সাংবাদিকতা কোনো উদ্দেশ্যের দ্বারা চালিত হয়, যখন সত্যকে উপেক্ষা করা হয়, তখন তা দশকের পর দশক ক্ষতি করতে পারে। পাঠক বা দর্শক আকৃষ্ট করার জন্য কেউ যদি চতুর শব্দ ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, ঠিক আছে—সামান্য আপস চলে। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য ভুল হয়, যদি লক্ষ্য হয় তথ্যকে নির্দিষ্ট এজেন্ডা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা, তবে তা গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আর এতে সত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এটাই আমার বিশ্বাস।

প্রধানমন্ত্রী: আমি মনে করি, একবার আমি লন্ডনে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। লন্ডনে একটি গুজরাটি সংবাদপত্র আছে, এবং তারা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল যেখানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল… তাই, আমার বক্তৃতায়, যেহেতু অনুষ্ঠানটি সাংবাদিকদের জন্য ছিল, আমি বলেছিলাম—"সাংবাদিকতা কেমন হওয়া উচিত? এটা কি ঘরের মাছির মতো হওয়া উচিত, নাকি মৌমাছির মতো?" আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে, ঘরের মাছি ময়লা বা আবর্জনায় বসে এবং আরও ময়লা ছড়ায়। কিন্তু মৌমাছি ফুলের ওপর বসে মধু সংগ্রহ করে এবং মিষ্টতা ছড়ায়। তবে কেউ যদি ভুল করে, মৌমাছি এমনভাবে কামড়ায় যে তিন দিন তার মুখ দেখাতে পারে না। কিন্তু কেউ আমার বক্তব্যের কেবল অর্ধেকটা তুলে নিয়ে একটি বিশাল বিতর্ক তৈরি করেছিল। সত্যি বলতে, আমি আসলে কাউকে কটাক্ষ করে বলছিলাম না। আমি প্রকৃতপক্ষে মৌমাছির শক্তি তুলে ধরছিলাম—যে ছোট কামড়ও মানুষকে তিন দিন মুখ লুকাতে বাধ্য করতে পারে। সাংবাদিকতার এই শক্তি থাকা উচিত। তবে, কিছু মানুষ ঘরের মাছির পথই পছন্দ করে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: এখন, আমার নতুন জীবনের লক্ষ্য হলো মৌমাছির মতো হওয়া। আপনি গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন… এবং ২০০২-এর আগে, আপনার সরকারের সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব বেশি ছিল না। কিন্তু ২০০২ থেকে আজ পর্যন্ত, আমার হিসাব অনুযায়ী, আপনি আটটি নির্বাচন জিতেছেন। ভারতে, ৮০ কোটিরও বেশি মানুষ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট দেয়। এত বড় নির্বাচন জেতা এবং ১৪০ কোটি মানুষের দেশে বিজয়ী হওয়ার জন্য কী লাগে? বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ কীভাবে আসে?

প্রধানমন্ত্রী: বিষয়টি হলো, আমি রাজনীতিতে বেশ দেরিতে প্রবেশ করি। প্রথমে, আমি সংগঠনের জন্য কাজ করতাম, নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পর্কিত দায়িত্ব সামলাতাম। এটি আমার সময়ের বেশিরভাগটাই নিত। গত ২৪ বছর ধরে, গুজরাটের মানুষ এবং দেশের মানুষ আমাকে সরকার প্রধান হিসেবে সেবা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। সম্পূর্ণ সমর্পণ নিয়ে, আমি মানুষকে এক ধরনের ঈশ্বর হিসেবে বিবেচনা করি। তাঁদের যে দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছে—আমি তা পূরণ করার চেষ্টা করি। আমি কখনও তাঁদের বিশ্বাস ভাঙতে দিই না। তাঁরা আমাকে যেমন দেখছেন, আমি তেমনই। আমার সরকার পরিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করে, অর্থাৎ প্রতিটি প্রকল্প ১০০% বাস্তবায়িত হয়, সমস্ত সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছায়—জাত, ধর্ম, বিশ্বাস, সম্পদ বা রাজনীতির কোনো পক্ষপাত ছাড়া। যখন নীতি সবার জন্য হয়, মানুষ মনে করে না যে তাদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি কেউ এখনও সুবিধাভোগী না হলেও, তাঁরা বিশ্বাস করেন ভবিষ্যতে সুবিধা পাবেন। এটি একটি বিশ্বাস তৈরি করে। এই বিশ্বাস প্রশাসনে এক মহান শক্তি। দ্বিতীয়ত, আমি নির্বাচন-কেন্দ্রিক শাসন পরিচালনা করি না; আমি মানুষ-কেন্দ্রিক শাসন পরিচালনা করি। আমার মনোযোগ থাকে মানুষের এবং দেশের সুবিধায়। শুরুতে, আমি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করেছিলাম, কিন্তু এখন আমি আমার দেশকে দিবয় এবং মানুষকে ঈশ্বর হিসেবে দেখি। যেভাবে একজন পুরোহিত তার দেবতার সেবা করে, আমি মানুষদের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করি। দ্বিতীয়ত, আমি কখনও জনসাধারণ থেকে দূরে থাকি না—আমি তাঁদের মধ্যে বাস করি এবং তাঁদেরই সঙ্গে থাকি। আমি খোলাখুলি বলি, "আপনি যদি ১১ ঘণ্টা কাজ করেন, আমি ১২ ঘণ্টা কাজ করব।" মানুষ এটি দেখে বিশ্বাস করে। আমার কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই—কোনো আত্মীয় বা ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমার অবস্থান থেকে সুবিধা পায় না। সাধারণ নাগরিক এই বিষয়গুলোকে মূল্য দেয়। সম্ভবত, আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। আরেকটি মূল কারণ হলো আমার দল, যার লাখ লাখ নিবেদিত কর্মী আছে, যারা শুধুমাত্র ভারতমাতা এবং দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে। তাঁরা নিজেদের জন্য কিছুই অর্জন করেননি—কখনও ক্ষমতার অবস্থান চাননি—তবুও তাঁরা অক্লান্তভাবে দেশের জন্য কাজ করেন। লাখ লাখ কর্মী দিন-রাত কাজ করেন। আমার দল বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। আমি গর্বিত যে আমি এর সদস্য। আমার দল তুলনামূলকভাবে তরুণ, তবুও লাখ লাখ কর্মীর প্রচেষ্টা রয়েছে। এই লাখ লাখ নিঃস্বার্থ কর্মীর কঠোর পরিশ্রম ভারতীয় জনতার বিজেপিতে বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। তাঁদের নিবেদনই আমাদের নির্বাচনে জয়ের কারণ। আমি কখনও গণনা করিনি কতগুলো নির্বাচন আমি জিতেছি, তবে মানুষের আশীর্বাদ সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিল।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি আপনার ভারতে চমৎকার নির্বাচন ব্যবস্থা এবং যন্ত্রণা সম্পর্কে ভাবছিলাম। ভারতের নির্বাচন পরিচালনার পদ্ধতি আমাকে বিস্মিত করেছে। অসংখ্য আকর্ষণীয় গল্প সামনে আসে। উদাহরণস্বরূপ, একটি নিয়ম আছে যে কোনো ভোটারকে ভোটকেন্দ্র থেকে দুই কিলোমিটারের বেশি দূরে থাকা যাবে না। এর কারণে, ভারতের সবচেয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোট মেশিন পৌঁছে দেওয়ার অনেক গল্প আছে। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য—প্রতিটি ভোটার গুরুত্বপূর্ণ। ৬০০ মিলিয়নেরও বেশি ভোটারের জন্য নির্বাচন পরিচালনা একটি বিশাল লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ। কি কোনো বিশেষ গল্প আছে যা আপনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে? অথবা সাধারণভাবে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে এত বিশাল নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হয় তা বর্ণনা করতে পারেন?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমেই, আমি আপনার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার জন্য। যারা বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাদের এই উত্তর শুনা উচিত। প্রায়শই আলোচনা কেবল নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের উপর কেন্দ্র করে, তবে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশাল আকৃতি সম্পর্কে নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নিন। ৯৮ কোটি নিবন্ধিত ভোটার ছিল, এবং প্রত্যেকের ছবি এবং সম্পূর্ণ জীবনী সংরক্ষিত ছিল। এই সংখ্যা উত্তর আমেরিকার জনসংখ্যার দ্বিগুণ এবং সমগ্র ইউরোপীয় ইউনিয়নের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এই ৯৮ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৬৪,৬ কোটি মানুষ তাদের ঘর থেকে বের হয়ে ভোট দিয়েছে, যদিও মে মাসে কিছু স্থানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। তাদের ভোট গণনা করা হয়েছে। তুলনায় বলতে গেলে, ভারতের ভোটার সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ। দেশের মধ্যে দশ লক্ষের বেশি ভোটকেন্দ্র ছিল। কল্পনা করুন এর জন্য কত জনবল প্রয়োজন! আমার দেশে ২,৫০০-এরও বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে— বিশ্বের মানুষ বিস্মিত হয় যে এমন একটি দেশ আছে যার ২,৫০০-এরও বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। আমাদের ৯০০-এরও বেশি টিভি নিউজ চ্যানেল ২৪×৭ চলছে এবং ৫,০০০-এরও বেশি দৈনিক সংবাদপত্র নির্বাচন কভার করছে। এত বিস্তীর্ণ ও বৈচিত্র্যময় দেশ হওয়া সত্ত্বেও, সবচেয়ে দরিদ্র গ্রামবাসীরাও প্রযুক্তিতে দ্রুত অভিযোজিত হয়। আমাদের নাগরিকরা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে, যা নির্বাচনকে দক্ষ ভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। কিছু দেশে নির্বাচন ফলাফল বের হতে মাসের পর মাস সময় লাগে, কিন্তু আমাদের দেশে, আমরা কোটি মানুষের ভোট গণনা করি এবং কয়েক দিনের মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করি। যেমন আপনি ঠিকই বললেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়, কখনও কখনও ভোটিং যন্ত্রপাতি এবং কর্মকর্তাদের বহনের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, অরুণাচল প্রদেশে একটি ভোটকেন্দ্র আছে যা সম্ভবত বিশ্বের সর্বোচ্চ। গুজরাটের গির বনাঞ্চলে, শুধুমাত্র একজন ভোটারের জন্য বিশেষ ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে—কারণ ভারতের গণতন্ত্রে প্রতিটি ভোট গুরুত্বপূর্ণ। আমরা নিয়মিতভাবে নির্বাচনকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা করি, যাতে নিখুঁত ও সুস্থ নির্বাচন নিশ্চিত হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন স্বাধীনভাবে পরিচালনা করে, সমস্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া নেয়। এটি নিজেই একটি উজ্জ্বল গল্প। আমি বিশ্বাস করি বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে একটি কেস স্টাডি হিসেবে অধ্যয়ন করা উচিত। এটি একটি প্রেরণার উৎস—প্রদর্শন করে যে আমাদের নাগরিক দের রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা কত গভীর। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে একটি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা উচিত যে গণতন্ত্র কিভাবে কাজ করা উচিত।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি গণতন্ত্রকে ভালোবাসি। এটি এমন একটি কারণ যার জন্য আমি আমেরিকাকেও ভালোবাসি। কিন্তু ভারতের গণতন্ত্রের কাজ করার পদ্ধতি—এর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। যেমন আপনি বললেন, ৯০ কোটি মানুষ ভোটের জন্য নিবন্ধিত! এটি সত্যিই একটি কেস স্টাডি। এত মানুষকে, তাদের স্বেচ্ছায়, উৎসাহের সঙ্গে একজন প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একত্রিত হতে দেখা অবিশ্বাস্য। তাঁরা উদ্দীপনা নিয়ে অংশ নেন। মানুষের কণ্ঠ শোনা যায়, তা অনুভব করা গুরুত্বপূর্ণ। এটা সত্যিই সুন্দর। কণ্ঠ শোনার প্রসঙ্গে—অনেক মানুষ আপনাকে ভালোবাসে। আপনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন। এত বছর ক্ষমতায় থাকার পর, কখনও কি আপনি প্রতিফলন করেন যে এত শক্তি থাকা আপনাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমেই, আমি মনে করি “ক্ষমতাধর” শব্দটি আমার জীবনের সঙ্গে মানায় না। আমি নিজেকে ক্ষমতাধর দাবি করতে পারি না, কারণ আমি নিজেকে একজন সেবক হিসেবে দেখি। আসলে, আমি নিজেকে “প্রধান সেবক”—মানুষের প্রধান সেবক—বলে অভিহিত করি। সেবা আমার নীতি। ক্ষমতার ব্যাপারে, আমি কখনও অধৈর্য হইনি। আমি কখনও ক্ষমতার খেলা খেলতে রাজনীতিতে প্রবেশ করি নি। ক্ষমতাধর হওয়ার পরিবর্তে, আমি বলব আমি কর্মনিষ্ঠ। আমি ক্ষমতাধর নই, কিন্তু কর্মনিষ্ঠ। আমার লক্ষ্য সবসময় মানুষদের সেবা করা এবং তাদের জীবনে ইতিবাচক অবদান রাখা। সেটিই আমার উদ্দেশ্য।

লেক্স ফ্রিডম্যান: যেমন আপনি উল্লেখ করেছেন, আপনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং আপনার পুরো হৃদয় দিয়ে কাজ করেন। কখনও কি একা অনুভব করেন?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, আমি কখনও একাকিত্ব অনুভব করি না। কারণ আমি “১+১” তত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাস করি। এই “১+১” তত্ত্ব আমাকে সহায়তা করে। এখন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, এই ১+১ কী বোঝায়, আমি বলি: প্রথম ১ হলো মোদি। এবং দ্বিতীয় +১ হলো ঈশ্বর। আমি কখনও একা নেই, কারণ তিনি সবসময় আমার সঙ্গে আছেন। এভাবেই আমি জীবনযাপন করি। যেমন আমি আগে বলেছি, আমি স্বামী বিবেকানন্দের নীতি অনুসরণ করেছি, যিনি বিশ্বাস করতেন “নারসেবা মানে নারায়ণসেবা”—মানুষকে সেবা করা মানে ঈশ্বরকে সেবা করা। আমার জন্য, দেশ দিভ্য, মানুষ দিভ্য। জনসেবা হল পরমেশ্বরের সেবা, এবং এ মনোভাব নিয়ে আমি কাজ করি। তাই, আমি কখনও একাকীতার মুখোমুখি হইনি। এমনকি কোভিড ১৯ লকডাউনের সময়, যখন ভ্রমণ সীমিত ছিল, আমি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। আমি ভিডিও কনফারেন্সে শাসনকাজ করেছি, ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম মডেল তৈরি করেছি, এবং ভার্চুয়াল মিটিং চালিয়ে কাজ বন্ধ হওয়া এড়িয়েছি। আমি সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি। এছাড়াও, আমি মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার চেষ্টা করেছি। আমি বরিষ্ঠ দলীয় কর্মীদের কল করেছি, যারা ৭০+ বছর বয়সী, এবং তাদের খোঁজ নিয়েছি। এরা ছিলেন সাধারণ কর্মী, অনেকেই নিম্নবিত্ত, যারা জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের সেবায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদেরকে কল করেছি: আপনি কেমন আছেন? আপনার পরিবার কেমন? মহামারীর সময় আপনার এলাকায় পরিস্থিতি কেমন? এটি আমার এবং তাদের সংযোগ শক্তিশালী করেছে। তাঁরা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তাঁরা বলত, “তাঁর কাঁধে এত দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও, তিনি আমাদের কথা মনে রাখছেন!” মহামারীর সময়, আমি প্রতিদিন ৩০-৪০টি এমন কল করেছি, অমোঘভাবে। এটি আমাকে বিশাল আনন্দ দিয়েছে, কারণ আমি পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে পুনঃসংযোগ করেছি এবং অতীতের স্মৃতিগুলো পুনর্বিবেচনা করেছি। তাই, আমার কাছে একাকিত্বের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি সবসময় নিজেকে ব্যস্ত এবং সংযুক্ত রাখার পথ খুঁজে পাই। এছাড়াও, আমি নিজের সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস রাখি। আমার প্রাথমিক বছরগুলিতে হিমালয়ে কাটানো সময় এটি করতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি অনেকের কাছ থেকে শুনেছি যে আপনি পরিচিত মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রমী। এর পিছনের মানসিকতা কী? আপনি প্রতিদিন দীর্ঘ সময় কাজ করেন। কখনও ক্লান্ত হন না কি? এ সবের মধ্যে আপনার শক্তি ও ধৈর্যের উৎস কী?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, প্রথমেই, আমি বিশ্বাস করি না যে আমি একমাত্র কঠোর পরিশ্রমী। চারপাশে দেখলে, আমি অনেককে আমার চেয়েও কঠোর পরিশ্রম করতে দেখি। যখন আমি একজন কৃষকের কথা ভাবি, আমি বুঝি তাঁরা কতটা পরিশ্রম করে, খোলা আকাশের নিচে ঘাম ঝরায়। যখন আমি আমাদের সৈন্যদের দেখি, আমি ভাবি তাঁরা কতটা চরম পরিস্থিতি সহ্য করে—কেউ তুষারপ্রাপ্ত অঞ্চলে, কেউ মরুভূমিতে, কেউ সাগরে—দিনরাত ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করে দেশের রক্ষা করে। যখন আমি একজন শ্রমিককে দেখি, আমি তাদের কঠোর পরিশ্রমে মুগ্ধ হই। এবং যখন আমি প্রতিটি পরিবারের মা ও বোনদের কথা ভাবি, দেখি তাঁরা কত কিছু করেন—প্রথমে ওঠেন, সবার শেষে ঘুমান, সবার খেয়াল রাখেন এবং সামাজিক দায়িত্ব সামলান। তাই যখন আমি এই সব ভাবি, আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি: আমি কীভাবে ঘুমাতে পারি? আমি কীভাবে বিশ্রাম নিতে পারি? আমার চারপাশের মানুষ – প্রতিটি ভারতীয়ের কঠোর পরিশ্রম আমাকে প্রেরণা দেয়। দ্বিতীয়ত, আমার দায়িত্ব আমাকে চালিয়ে রাখে। দেশের মানুষ আমাকে একটি কর্তব্য অর্পণ করেছে, এবং আমি মনে করি আমি এখানে ক্ষমতা ভোগ করতে নয়, বরং সম্পূর্ণ নিষ্ঠা নিয়ে দেশ সেবা করতে। আমি হয়তো দুইটি কাজ করতে পারব না, কিন্তু আমার প্রচেষ্টায় কখনও ঘাটতি হবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার সময় এবং গুজরাটে, তারপর দিল্লিতে আসার সময়, আমি দেশের মানুষকে একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি কখনও কঠোর পরিশ্রম থেকে দূরে থাকব না। দ্বিতীয়ত, আমি বলেছিলাম যে আমি কখনও খারাপ উদ্দেশ্যে কাজ করব না। এবং তৃতীয়ত, আমি বলেছিলাম যে আমি কখনও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করব না। আজ, ২৪ বছর সরকার প্রধান থাকার পর, আমি নিজেকে এই তিনটি নীতিতে আবদ্ধ রেখেছি। এবং আমি দেশের ১৪০ কোটি মানুষের আশা ও প্রয়োজন পূরণের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমার শক্তি ও প্রতিশ্রুতি আগের মতোই অপরিবর্তিত।

লেক্স ফ্রিডম্যান: একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং গণিতপ্রেমী হিসেবে আমি অবশ্যই জানতে চাই—শ্রীনিবাস রামানুজান ছিলেন প্রায় একশ বছর আগের একজন ভারতীয় গণিতজ্ঞ। তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা গণিতজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত। সম্পূর্ণ স্বশিক্ষিত, তিনি দারিদ্র্যে বড় হয়েছেন। আপনি প্রায়ই তাঁর কথা বলেছেন। তাঁর থেকে আপনি কী অনুপ্রেরণা পান?

প্রধানমন্ত্রী: দেখুন, আমি তাঁর প্রতি গভীর সম্মান অনুভব করি, এবং আমার দেশের সবাই তাঁকে সম্মান করেন। কারণ আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে। যদি আপনি লক্ষ করেন, অনেক বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত মনও আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত—তাঁদের আধ্যাত্মিকতার সাথে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই। শ্রীনিবাস রামানুজন বলতেন, তাঁর গাণিতিক ধারণাগুলো আসে তাঁর আরাধ্য দেবীর কাছ থেকে। এর অর্থ হলো, ধারণাগুলো আসে গভীর নিষ্ঠা থেকে। আর নিষ্ঠা শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম নয়—এটি একটি উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ, নিজেকে এতটাই গভীরভাবে নিমজ্জিত করা যে কাজের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। আমরা যত বেশি জ্ঞানের বিভিন্ন উৎসের প্রতি উন্মুক্ত থাকব, তত বেশি ধারণা পাব। এছাড়াও, তথ্য এবং জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মানুষ তথ্যকে জ্ঞানের সাথে গুলিয়ে ফেলেন—তাঁরা প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে চলেন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে তথ্য থাকা মানেই জ্ঞান থাকা। জ্ঞান হলো একটি শৃঙ্খলা—এটি ধীরে ধীরে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে বিকশিত হয়। আমাদের এই পার্থক্য বুঝতে হবে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে তা পরিচালনা করতে হবে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনার ভাবমূর্তি একজন দৃঢ় সিদ্ধান্তগ্রাহক নেতা হিসেবে গড়ে উঠেছে। তাহলে আপনি কি বলতে পারেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনার কর্মপদ্ধতি কেমন? যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যখন কোনো স্পষ্ট নজির নেই, প্রচুর অনিশ্চয়তা বিরাজ করে, এবং যখন ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন—তখন আপনি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেন?

প্রধানমন্ত্রী: এর অনেকগুলো দিক রয়েছে। প্রথমত, আমি মনে করি আমি সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় রাজনীতিবিদ যিনি দেশের প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ জেলায় রাত কাটিয়েছি। পূর্বে আমি ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছি। আমি যা শিখেছি এবং দেখেছি তা হলো—প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভূমিতল থেকে—কোনো বই বা অন্যের বর্ণনার ওপর নির্ভর নয়। দ্বিতীয়ত, শাসনকার্যের প্রেক্ষাপটে, আমার ওপর এমন কোনো বোঝা নেই যা আমাকে বাধ্য করতে পারে। তৃতীয়ত, আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি সহজ মানদণ্ড রয়েছে: আমার দেশ সর্বাগ্রে। আমি সর্বদা নিজেকে প্রশ্ন করি: আমি যা করছি তা কি দেশের ক্ষতি করছে? মহাত্মা গান্ধী প্রায়শই বলতেন: "যখন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় থাকবেন, আপনার দেখা সবচেয়ে দরিদ্র মানুষটির মুখ স্মরণ করুন। তারপর ভাবুন, আপনার সিদ্ধান্ত কি তার সাহায্য করবে?" এই নীতি আমাকে অত্যন্ত সাহায্য করে। আমি সর্বদা সাধারণ মানুষকে চিন্তা করি এবং যাচাই করি যে আমার সিদ্ধান্ত তাঁদের উপকারে আসে কিনা।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমি তথ্যের সাথে সুদৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকি। আমার সরকারি কর্মকর্তারা হয়তো ঈর্ষা বা হতাশা বোধ করতে পারেন, কারণ আমার কাছে বহু তথ্যের সরাসরি চ্যানেল রয়েছে। আমি কেবল ব্রিফিং-এর ওপর নির্ভর করি না। আমি একাধিক উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করি। এছাড়াও, আমি ছাত্রের মতো মানসিকতা বজায় রাখি। যখন কোনো কর্মকর্তা কিছু বলেন, আমি তাঁদের প্রশ্ন করি—"কেন এটি এমন? এরপর কী ঘটবে? এটি কীভাবে কাজ করে?" যদি আমার কাছে ভিন্ন তথ্য থাকে, আমি তাঁদের মতামত চ্যালেঞ্জ করি। এই গভীর বিশ্লেষণ আমাকে বিষয়টির সারমর্ম উদ্ঘাটন করতে সাহায্য করে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, আমি তা সমমনা ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করি এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করি। যখন আমি নিশ্চিত হই, তখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যাই।

উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে: আমি নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তাঁরা আমাকে বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন—"এই দেশ এটি করেছে, সেই দেশ ওটা করেছে। আপনিও তাই করুন।" রাজনৈতিক দলগুলো চাপ দিয়ে বলছিল—"মানুষকে এত টাকা দিন, ওটা করুন!" কিন্তু আমি তাড়াহুড়া করিনি। আমি পরিস্থিতি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছি এবং দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, "কোনো ভারতীয়কে অনাহারে থাকতে দেওয়া যাবে না।" মৌলিক চাহিদা পূরণ করা অপরিহার্য। আমি পরিস্থিতি অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করেছি। ফলাফল: অনেক দেশ কোভিড-পরবর্তী মহামূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হলেও, আমাদের দেশ স্থিতিশীল ছিল। আজ, আমার দেশ বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতি।

আমার ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতাও রয়েছে। যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেশের জন্য সঠিক হয়, আমি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত। আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করি। যদি কিছু ভুল হয়, অন্যকে দোষারোপ করি না। যখন নেতা দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাঁর দল আস্থা অর্জন করে। মানুষ বুঝতে পারে, "এই মানুষটি আমাদের ব্যর্থ হতে দেবেন না।" আমি জনগণকে বলেছি, ভুল হতে পারে। তবে উদ্দেশ্য কখনও ভুল হবে না। মানুষ এটি বোঝেন এবং গ্রহণ করেন।

লেক্স ফ্রিডম্যান: কয়েক সপ্তাহ আগে, আপনি ফ্রান্সে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্মেলনে চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আপনি সেখানে ভারতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রকৌশলীদের বিশাল সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন। কীভাবে ভারত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে? বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের পিছনে রয়েছে। ভারতকে এগিয়ে যেতে হলে কী করতে হবে?

প্রধানমন্ত্রী: আমি যা বলব তা হয়তো কিছুটা সাহসী শোনাবে। তবে আমি বলি—বিশ্ব যতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নয়ন করুক না কেন, ভারত ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অসম্পূর্ণ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি একটি দেশ একাই তৈরি করতে পারে? না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন হলো সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা। ভারত কেবল মডেল তৈরি করছে না, নির্দিষ্ট কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক প্রয়োগও তৈরি করছে। জিপিইউ-র প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আমরা একটি অনন্য, বাজারভিত্তিক মডেল গ্রহণ করেছি। ভারতের তরুণদের প্রতিভাই হলো প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা, এবং কেবল এর মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফল হতে পারে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: অনেক শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি নেতা ভারতীয় বংশোদ্ভূত—যেমন সুন্দর পিচাই, সত্য নাদেলা। তাঁদের ভারতীয় পটভূমি কীভাবে সফল হতে সাহায্য করেছে?

প্রধানমন্ত্রী: ভারতের মূল্যবোধ শেখায় জন্মভূমি ও কর্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধা। যেখানেই থাকুন, সর্বোত্তম অবদান রাখতে হবে। ভারতীয়রা যে কোনো অবস্থানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন। তাঁরা সঠিক কাজে মনোনিবেশ করেন, সবার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে পারেন। দলগত কাজের দক্ষতা, বিশ্লেষণাত্মক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা—এই সব গুণাবলী তাঁদেরকে বিশ্বজুড়ে সফল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মহাকাশ খাত: সম্প্রতি এই খাতটি বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে, এবং মাত্র দুই বছরে ২০০টিরও বেশি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চন্দ্রযান—ভারতের চন্দ্র অভিযান। এর ব্যয় এতটাই কম যে হলিউডের একটি চলচ্চিত্রের বাজেটের চেয়েও কম! বিশ্ব আমাদের উদ্ভাবনী দক্ষতা প্রত্যক্ষ করে সম্মান প্রদর্শন করে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি মানব বুদ্ধিমত্তার কথা বললেন। এ নিয়ে কি উদ্বেগ রয়েছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের প্রতিস্থাপন করবে?

প্রধানমন্ত্রী: প্রতিটি যুগেই বলা হয়েছে যে প্রযুক্তি মানবতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মানুষ সবসময়ই একধাপ এগিয়ে থেকেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে তাদের প্রকৃত মানবত্ব সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। তবে কল্পনাশক্তি কখনও প্রতিস্থাপিত হতে পারে না।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আমি সম্পূর্ণ একমত। কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, চেতনা, ভালোবাসা, স্বপ্ন—এগুলোই মানুষকে বিশেষত্ব দেয়।

প্রধানমন্ত্রী: আর দেখুন যত্ন—প্রকৃত মানুষ একে অপরের প্রতি যত্নশীল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি তা করতে পারে?

লেক্স ফ্রিডম্যান: এটি একুশ শতকের অন্যতম বড় প্রশ্ন। আপনি প্রতিবছর "পরীক্ষা পে চর্চা" আয়োজন করেন। আপনি শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করেন এবং পরীক্ষা, মানসিক চাপ সামলানো ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন। শিক্ষার্থীরা ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় কী ধরনের পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং কেন এটি এত চাপের—তা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে পারেন?

প্রধানমন্ত্রী: সাধারণভাবে সমাজে একটি বিশেষ মানসিকতা গড়ে উঠেছে। স্কুলে সাফল্যকে প্রায়ই শুধুমাত্র শীর্ষ র‍্যাঙ্কিং দিয়ে মাপা হয়। পরিবারও এই ধরনের পরিবেশ তৈরি করে। ছাত্রছাত্রীরা মনে করে তাদের জীবন কেবলমাত্র দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। নতুন শিক্ষানীতি এই মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। "পরীক্ষা পে চর্চা" ছাত্রছাত্রীদের দুশ্চিন্তা বোঝার ও তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার একটি সুযোগ। এই প্রক্রিয়ায় ছাত্রছাত্রীরা শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, জীবনদক্ষতা ও সৃজনশীলতাও শেখে।

উদাহরণস্বরূপ, আমার শৈশবে আমার শিক্ষক একটি উদ্ভাবনী শিক্ষাপদ্ধতি ব্যবহার করতেন—ছোট ছোট উপকরণ দিয়ে গণিত শেখাতেন। আরেকজন শিক্ষক প্রতিদিন একটি ডায়েরিতে এক বাক্য লিখতে বলতেন, পরের দিন অন্য ছাত্র সেই বাক্যটি নিয়ে আরও বিস্তৃত করে লিখত। এই ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। আমাদের নতুন শিক্ষানীতি এই দিকেই এগিয়ে চলেছে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ছাত্রছাত্রীদের আরও কিছু পরামর্শ দিতে পারেন কীভাবে তারা তাদের কর্মজীবনে সফল হতে পারে? তারা কীভাবে তাদের পেশা নির্বাচন করবে এবং সাফল্য অর্জন করবে? এই পরামর্শ শুধু ভারতের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নয়, বিশ্বের যে কেউ আপনার কথায় অনুপ্রেরণা খুঁজে পান তাদের জন্যও প্রযোজ্য।

প্রধানমন্ত্রী: আমি বিশ্বাস করি, আপনি যে কোনো কাজই করুন না কেন, যদি আপনি তা সম্পূর্ণ নিষ্ঠা ও অঙ্গীকারের সাথে করেন, তাহলে আজ নয় কাল আপনি অবশ্যই সেই কাজে দক্ষ হয়ে উঠবেন। আপনার দক্ষতাই আপনার জন্য সাফল্যের দরজা খুলে দেবে। একজন মানুষকে তার দক্ষতা অবিরাম উন্নত করতে হবে এবং কখনও নিজের শেখার ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। কেউ যদি তার শেখার ক্ষমতাকে মূল্য দেয় এবং সবকিছু থেকে শেখার চেষ্টা করে, তাহলে সে অসীম পরিমাণে এগিয়ে যেতে পারে।

কিছু মানুষ কেবল নিজেদের কাজের দিকে মনোযোগ দেয়, আবার কেউ কেউ তাদের চারপাশের কাজকর্মও পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করে, যা তাদের ক্ষমতাকে দ্বিগুণ বা তিনগুণ করে তোলে। আমি তরুণদের বলব—হতাশ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এই পৃথিবীতে এমন একটি কাজ অবশ্যই আছে যা ঈশ্বর আপনার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিন যাতে আপনি সুযোগের উপযুক্ত ও সক্ষম হয়ে উঠতে পারেন।

উদাহরণস্বরূপ, কেউ হয়তো বলবে, 'আমি চিকিৎসক হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তাই আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এখন আমি শিক্ষক।' আপনি যদি এইভাবে ভাবেন, তাহলে তা কখনো কাজে আসবে না। ঠিক আছে, আপনি চিকিৎসক হতে পারেননি, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আপনি শত শত ছাত্রছাত্রীকে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করতে পারেন। একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনি হয়তো রোগীদের চিকিৎসা করতেন, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আপনি ভবিষ্যতের চিকিৎসক তৈরি করতে পারেন যারা লক্ষ লক্ষ মানুষের চিকিৎসা করবে। এটি জীবনের একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। যা অর্জন করতে পারেননি তার ওপর মনোযোগ না দিয়ে, দেখুন আপনি কীভাবে অবদান রাখতে পারেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঈশ্বর প্রত্যেককে কিছু না কিছু অনন্য শক্তি দিয়েছেন। নিজের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস হারাবেন না। আত্মবিশ্বাস রাখুন যে সুযোগ এলে আপনি তা কাজে লাগাবেন, সাফল্য অর্জন করবেন। এই মানসিকতা থাকলে মানুষ সবসময়ই সফল হয়।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে চাপ, সংগ্রাম এবং তাদের পথচলায় আসা নানা সমস্যার সাথে মোকাবিলা করবে?

প্রধানমন্ত্রী: প্রথমত, তাদের বুঝতে হবে যে পরীক্ষাই জীবন নয়। পরিবারকেও বুঝতে হবে যে তাদের সন্তানরা সমাজে প্রদর্শনের জন্য নয়—'দেখো, আমার সন্তান কত ভালো করেছে!'—এই ধারা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ছাত্রছাত্রীদের সবসময় ভালোভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কেবল তখনই তারা চাপ ছাড়াই পরীক্ষা দিতে পারবে। তাদের আত্মবিশ্বাস ও পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

অনেক সময় পরীক্ষার খাতা পেয়েই ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা অপ্রয়োজনীয় কারণে মনোযোগ হারিয়ে ফেলে—'হায়, আমার কলমটা ঠিকমতো কাজ করছে না!' বা 'আমার পাশের জন আমার মনোযোগ নষ্ট করছে!'—এসব তখনই ঘটে যখন আত্মবিশ্বাস কম থাকে। কিন্তু ছাত্রছাত্রী যদি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে এবং কঠোর পরিশ্রম করে, তাহলে মাত্র কয়েক মিনিটেই সে নিজেকে আবার প্রস্তুত করে নিতে পারে। গভীর শ্বাস নিন, মনোযোগ দিন, প্রশ্নগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ুন এবং সময় ভাগ করে নিন। যারা আগে থেকেই অনুশীলন করে উত্তর লেখার অভ্যাস গড়ে তুলেছে, তারা সহজেই ও কোনো সমস্যা ছাড়াই পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পারে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি বলেছেন, মানুষকে সবসময় শেখার চেষ্টা করতে হবে। আপনি নিজে কীভাবে নতুন কিছু শেখেন? আজীবন শেখার জন্য আপনার কী পরামর্শ?

প্রধানমন্ত্রী: যেমনটা আমি আগে বলেছি, আমার প্রাথমিক জীবনে আমি অনেক পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এখন সময় কম, কিন্তু আমি একজন মনোযোগী শ্রোতা ও পর্যবেক্ষক। আমি সম্পূর্ণভাবে বর্তমান মুহূর্তে থাকি। কারও সাথে দেখা করার সময় আমি পুরোপুরি মনোযোগী থাকি। এটি আমাকে খুব দ্রুত বিষয়গুলো বুঝে নেওয়ার সুযোগ দেয়।

দ্বিতীয়ত, শেখা মানে শুধু জ্ঞান অর্জন নয়—সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। ভালো চালক হতে হলে শুধু দক্ষ চালকদের আত্মজীবনী পড়লেই হবে না; আপনাকে গাড়িতে বসতে হবে, স্টিয়ারিং ধরতে হবে এবং গাড়ি চালাতে হবে। আপনাকে ঝুঁকি নিতে হবে। আপনি যদি ভাবেন, 'দুর্ঘটনা হলে কী হবে?'—তাহলে কিছুই শিখতে পারবেন না। যারা বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকে, তারা একটি মূল নীতি মেনে চলে: অতীত মানেই অতীত—সেটা চলে গেছে। এই মুহূর্তটাকে অনুভব করুন—নইলে আপনি ভবিষ্যতের পেছনে ছুটবেন আর বর্তমানটা হারিয়ে ফেলবেন।

লেক্স ফ্রিডম্যান: হ্যাঁ, আমি আপনার মানুষজনের সাথে সাক্ষাতের অনেক গল্প শুনেছি, যেখানে নানা বিভ্রান্তি থাকে। কিন্তু এখন কোনো বিভ্রান্তি নেই—শুধু আমরা দুজন, সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে কথা বলছি। এটাই তো সুন্দর।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি কি কখনও নিজের মৃত্যুর কথা ভাবেন? মৃত্যুকে ভয় পান?

প্রধানমন্ত্রী: আমি একটি প্রশ্ন করতে পারি?

লেক্স ফ্রিডম্যান: অবশ্যই।

প্রধানমন্ত্রী: জন্মের পর আমাদের সামনে আছে জীবন এবং মৃত্যু। এই দুটির মধ্যে কোনটি সবচেয়ে নিশ্চিত?

লেক্স ফ্রিডম্যান: মৃত্যু!

প্রধানমন্ত্রী: মৃত্যু! আপনি সঠিক উত্তর দিয়েছেন। জন্মের মুহূর্ত থেকেই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। জীবন হচ্ছে বৃদ্ধি আর বিকাশের। মৃত্যু যখন নিশ্চিত—এটা জানা থাকলে কেন ভয় পাবেন? বরং আপনার শক্তি, সময় ও বুদ্ধি জীবনে বিনিয়োগ করুন। জীবনকে পূর্ণভাবে বিকশিত হতে দিন। মৃত্যুর চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিন।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ভবিষ্যতের জন্য আপনার প্রত্যাশা কী? শুধু ভারতের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যও।

প্রধানমন্ত্রী: আমি স্বভাবতই খুব আশাবাদী মানুষ। হতাশা বা নেতিবাচকতা আমার স্বভাবের অংশ নয়। মানব ইতিহাস প্রমাণ করে, মানবজাতি বড় বড় সংকট অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে। মানুষের নতুন বিষয় গ্রহণ করার স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ করার ক্ষমতাই মানবজাতির সবচেয়ে বড় শক্তি।

লেক্স ফ্রিডম্যান: আপনি কি আমাকে কোনো হিন্দু প্রার্থনা বা ধ্যানপদ্ধতি শেখাতে পারেন? আমি গায়ত্রী মন্ত্র অনুশীলন করছি।

প্রধানমন্ত্রী: হ্যাঁ, বলুন।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বাহা... ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ। কেমন হলো?

প্রধানমন্ত্রী: খুবই ভালো! এটি সূর্য উপাসনার সাথে সম্পর্কিত। প্রাচীনকালে সূর্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রতিটি মন্ত্র জীবনের বিভিন্ন দিকের সাথে যুক্ত। নিয়মিত উচ্চারণ মনোনিবেশ, শৃঙ্খলা এবং অভ্যন্তরীণ সামঞ্জস্য নিয়ে আসে।

লেক্স ফ্রিডম্যান: ধ্যানের সময় আপনার মন কোথায় যায়?

প্রধানমন্ত্রী: আমাদের ভাষায় সহজ শব্দ আছে—'ধ্যান'। এর মানে হলো মনোযোগ বর্তমান মুহূর্তে ধরে রাখা। হিমালয়ে এক সাধুর কাছ থেকে আমি শিখেছি—শুধু জলধারার শব্দ শুনুন। প্রথমে কঠিন মনে হলেও, সময়ের সাথে এটাই আমার ধ্যান হয়ে গেছে। মনে রাখবেন, ছোট বিষয়ও মনকে বিক্ষিপ্ত করতে পারে। আমাদের শাস্ত্র জীবন ও মৃত্যুকে সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণ: ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্... এবং সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ... ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তিঃ। এই মন্ত্রগুলো হাজার বছরের জ্ঞান ও আমাদের ঋষিদের গবেষণার ফসল।

লেক্স ফ্রিডম্যান: শান্তি, শান্তি, শান্তি। এই সম্মান ও আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।

প্রধানমন্ত্রী: আমি এই কথোপকথনের সুযোগটি উপভোগ করেছি। আপনি দুই দিন উপবাস করেছেন, তাই হঠাৎ করে খাবেন না। প্রথমে কিছু তরল পান করুন। আজ আমরা অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, যা আমি সাধারণত ব্যক্তিগত রাখি। আপনার শ্রোতারা এটি উপভোগ করবেন। আমার শুভকামনা রইল। ধন্যবাদ!

লেক্স ফ্রিডম্যান: ধন্যবাদ! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে এই আলোচনার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এখন আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই এবং নিজের মনের কিছু ভাবনা ভাগ করে নিতে চাই। আপনারা কিছু জানতে চাইলে বা কোনো কারণে আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে, ভিজিট করুন lexfridman.com/contact।

প্রথমেই, আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কাজ করা দলটিকে অভিনন্দন জানাতে চাই। এটি একটি অসাধারণ দল ছিল! তারা অত্যন্ত দক্ষ, কার্যকর এবং চমৎকার যোগাযোগকারী ছিলেন। মোটকথা, এটি সম্পূর্ণভাবেই একটি দুর্দান্ত দল ছিল। যেহেতু আমি ইংরেজিতে কথা বলেছি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীজি হিন্দিতে কথা বলেছেন, তাই আমাদের দোভাষী সম্পর্কে কিছু বলতেই হবে। তিনি সত্যিই অসাধারণ ছিলেন। যতটা প্রশংসা করা যায়, ততটুকুও কম। যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে অনুবাদের মান—তার সমস্ত কাজই নিখুঁত ছিল।

আর দিল্লি এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময়, আমি এমন কিছু বিষয় লক্ষ করেছি যা বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মনে হয়েছে যেন আমি অন্য কোনো জগতে প্রবেশ করেছি। সাংস্কৃতিকভাবে, আমি এর আগে এমন কিছু কখনো দেখিনি। মানুষ যেভাবে একে অপরের সাথে মেলামেশা করে—অবিশ্বাস্য ও আকর্ষণীয় মানুষজন! অবশ্যই, ভারত বিভিন্ন সংস্কৃতির মিশ্রণ, আর দিল্লি তার মাত্র একটি ঝলক। ঠিক যেমন শুধুমাত্র নিউইয়র্ক, টেক্সাস বা আইওয়া সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করে না, সেগুলো কেবল আলাদা আলাদা রূপ।

এই ভ্রমণে আমি রিকশায় ঘুরেছি। রাস্তায় হেঁটেছি, মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলেছি। অবশ্য, বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার মতো, এখানেও কিছু মানুষ ছিল যারা প্রথমে আমাকে পর্যটক ভেবে কিছু বিক্রি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, সবসময় যেমন করি, আমি এই ধরনের ভাসা ভাসা আলাপ এড়িয়ে গেছি। বরং আমি সরাসরি মানুষের সাথে হৃদয় দিয়ে কথা বলেছি—তাদের ভালোবাসা, ভয়, আনন্দ ও দুঃখের কথা। মানুষের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, তারা দ্রুত বাহ্যিক আবরণের আড়ালে দেখতে পায়। আপনি যদি সত্যিকারের মন দেখান, তারা তা চিনতে পারে। আর ভারতীয়দের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই আমি এরকম পেয়েছি—তারা অবিশ্বাস্য রকমের দয়ালু ও মানবিক ছিল।

তারা ইংরেজি না জানলেও, বোঝাপড়া করা সহজ ছিল। হয়তো এ পর্যন্ত যত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, ভারতের মানুষকে বোঝা সবচেয়ে সহজ ছিল—চোখ, মুখভাব, শরীরের ভাষা সবকিছুই স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ইউরোপে ভ্রমণের সময় মানুষকে বোঝা তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল। কিন্তু ভারতে সবাই খোলামেলা।

দিল্লিতে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে, মানুষের সাথে মিশে আমি অসাধারণ অভিজ্ঞতা পেয়েছি। সাধারণভাবে, মানুষকে বোঝার ক্ষেত্রে চোখ প্রায়ই কথার চেয়ে বেশি বলে। আমরা মানুষেরা আকর্ষণীয় প্রাণী। শান্ত ঢেউয়ের নিচে প্রায়ই একটি গভীর, উত্তাল সমুদ্র লুকিয়ে থাকে। কথোপকথনের সময় আমি যা চেষ্টা করি—তা ক্যামেরার সামনে হোক বা বাইরে—সেই গভীরতায় পৌঁছানো।

ভারতে কাটানো এই কয়েক সপ্তাহ ছিল জাদুকরী অভিজ্ঞতার মতো। এমনকি ট্রাফিকও নিজেই অবিশ্বাস্য—যেন স্বয়ংচালিত গাড়ির জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা। মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি-প্রামাণ্যচিত্রের দৃশ্য—যেখানে হাজার হাজার মাছ একসাথে দ্রুত গতিতে সাঁতার কেটে যায়, মনে হয় তারা এলোমেলো, কিন্তু বিস্তৃত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বোঝা যায় তারা নিখুঁত ছন্দে চলছে। আমি অবশ্যই শীঘ্রই ফিরে আসার পরিকল্পনা করছি, বন্ধু পল রোসোলি ও আরও কিছু বন্ধুর সাথে, এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত ঘুরে দেখব।

এখন আমি সেই বইটির কথা বলতে চাই, যা প্রথম আমাকে ভারতের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার দিকে আকর্ষিত করেছিল। সেই বই হলো 'সিদ্ধার্থ'—হেরমান হেসের লেখা। কিশোর বয়সে আমি হেসের বেশিরভাগ বিখ্যাত বই পড়েছি। পরে আবার পড়ার সময়, আমি এই বইটিতে পৌঁছেছি যখন আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সাহিত্য পড়ছিলাম—দস্তয়েভস্কি, কামু, কাফকা, অরওয়েল, হেমিংওয়ে, কেরোয়াক, স্টেইনবেক। অনেক বইই মানুষের জীবনের সমস্যার কথা তুলে ধরে। কিন্তু 'সিদ্ধার্থ' আমাকে দেখিয়েছিল কীভাবে এই সমস্যাগুলোকে প্রাচ্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা যায়।

হেসের জীবন তখন অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছিল—বিবাহবিচ্ছেদ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, তীব্র মানসিক যন্ত্রণা। তিনি কার্ল ইয়ুংয়ের সাথে মনোবিশ্লেষণ শুরু করেন, যা তাকে প্রাচ্য দর্শনের দিকে নিয়ে যায়। হেস হিন্দু ও বৌদ্ধ শাস্ত্র এবং উপনিষদ পড়েছেন, এমনকি ভগবদগীতা নিয়েও গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন। 'সিদ্ধার্থ' লেখা নিজেই ছিল একটি দীর্ঘ যাত্রা। হেস ১৯১৯ সালে লিখতে শুরু করেন এবং তিন বছরে শেষ করেন।

বইটি দেখায়, সিদ্ধার্থ এক যুবক যিনি ভারতবর্ষে সম্পদ ও আরাম ত্যাগ করে পরম সত্য খোঁজার যাত্রা শুরু করেন। প্রতিটি পাতায় তার ব্যক্তিগত সংগ্রাম, অশান্তি, অসন্তুষ্টি এবং সত্য আবিষ্কারের গভীর আকাঙ্ক্ষা অনুভব করা যায়। হেসের কাছে এটি শুধু দর্শন ছিল না—দুঃখ থেকে মুক্তি এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের প্রচেষ্টা।

দুটি শিক্ষা আজও আমার মনে গভীরভাবে গেঁথে আছে—

 

১. সিদ্ধার্থ নদীর ধারে বসে শুনেছিলেন জীবনের সব সুর—অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন একসঙ্গে বয়ে চলেছে। তখনই তিনি বুঝেছিলেন, জীবন যেমন ক্ষণিক, তেমনি আবার অনন্ত।

২. জীবনের আসল শিক্ষা কেবল অভিজ্ঞতা থেকেই আসে। সুখ–দুঃখ, ভুল–ত্রুটি, কষ্ট—সবই আমাদের বাড়তে শেখায়, জ্ঞান দেয়।

সিদ্ধার্থ এক দৃশ্যে বলেন: “আমি ভাবতে পারি, আমি অপেক্ষা করতে পারি, আমি উপবাস করতে পারি।”

তার মানে—

আমি ভাবতে পারি: চিন্তাশক্তিই জীবনের আসল মান।

আমি অপেক্ষা করতে পারি: ধৈর্যই সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি।

আমি উপবাস করতে পারি: কমে বাঁচতে জানা, শান্ত থাকতে শেখা—মুক্তির প্রথম ধাপ।

মনে রাখুন—মন, শরীর বা সমাজ যতই আপনাকে বেঁধে রাখতে চাইুক, এই স্বাধীনতাই আসল মুক্তি।

ঠিক আছে বন্ধুরা, আজকের মতো এ পর্যন্তই। সবসময়ের মতো শোনার জন্য ধন্যবাদ, পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ। শেষ করি ভগবদ্‌গীতার একটি অমর বাণী দিয়ে—

“যে ব্যক্তি জীবনের একত্ব উপলব্ধি করেন, তিনি নিজের আত্মাকে সব জীবের মধ্যে দেখেন, সব জীবকে নিজের আত্মায় খুঁজে পান, আর সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন।”

শোনার জন্য ধন্যবাদ। আবার দেখা হবে আগামী দিনে।

 

SC/RS


(रिलीज़ आईडी: 2162276) आगंतुक पटल : 78
इस विज्ञप्ति को इन भाषाओं में पढ़ें: English , Urdu , हिन्दी , Marathi , Manipuri , Assamese , Punjabi , Gujarati , Odia , Tamil , Telugu , Kannada , Malayalam