প্রধানমন্ত্রীরদপ্তর
লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদজ্ঞাপক জবাবী ভাষণ
Posted On:
10 FEB 2021 11:44PM by PIB Kolkata
নয়াদিল্লি, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
মাননীয় সভাপতিজি,
আমি রাষ্ট্রপতিজির প্রেরণাদায়ী ভাষণের জন্য কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন প্রস্তাবে শরিক হতে পেরে আনন্দিত। রাষ্ট্রপতিজিকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য কিছু কথা বলব। রাষ্ট্রপতিজির ভাষণ ভারতের ১৩০ কোটি নাগরিকের সঙ্কল্পশক্তির পরিচায়ক। কঠিন সময়ে এই দেশ কিভাবে নিজের পথ বেছে নেয় আর নতুন পথ তৈরি করে অর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে যায় - এসব বিষয় রাষ্ট্রপতিজি তাঁর ভাষণে বিস্তারিতভাবে বলেছেন। তাঁর এক একটি শব্দ দেশবাসীর মনে নতুন বিশ্বাস সৃষ্টিকারী এবং প্রত্যেকের হৃদয়ে দেশের জন্য কিছু করার প্রেরণা জাগায়। আর সেজন্য আমরা তাঁকে যত কৃতজ্ঞতাই জানাই না কেন তা কম পড়ে যাবে। এই সভায় ১৫ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা হয়েছে। রাত ১২টা পর্যন্ত আমাদের সমস্ত মাননীয় সাংসদ চেতনাকে জাগিয়ে রেখেছেন, আলোচনাকে জীবন্ত বানিয়েছেন। এই চর্চায় অংশগ্রহণের জন্য সমস্ত মাননীয় সদস্যকে আমি হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশেষভাবে আমাদের মহিলা সাংসদদের কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, কারণ, এই আলোচনায় তাঁদের অংশগ্রহণও বেশি ছিল। তাঁদের আলোচনায় যেমন তীক্ষ্ণতা ছিল, তেমনই গবেষণা করে বক্তব্য পেশ করার প্রচেষ্টা ছিল। আপনাদের এ ধরনের প্রস্তুতি এই সভা ও আলোচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেজন্য আমি বিশেষভাবে মহিলা সাংসদদের অভিনন্দন জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বছরের দরজায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। এই ৭৫তম বর্ষ প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য গর্বের এবং এগিয়ে যাওয়ার উৎসবও। সেজন্য সমাজ ব্যবস্থার যে জায়গাতেই আমরা থাকি না কেন, দেশের যে কোনও কোণাতেই থাকি না কেন, দেশের সামাজিক-আর্থিক ব্যবস্থায় আমাদের স্থান যাই-ই হোক না কেন, আমরা সবাই মিলে স্বাধীনতার এই উৎসব থেকে নতুন প্রেরণা, নতুন শপথ নিয়ে ২০৪৭-এ দেশ যখন স্বাধীনতার ১০০তম বছর উদযাপন করবে, সেই সময়ের দিকে এগিয়ে যাব। মাঝের ২৫ বছরে আমরা দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চাই, বিশ্বে আমাদের উপস্থিতি কিভাবে জাহির করব, সেই সঙ্কল্প এখন প্রত্যেক দেশবাসীর হৃদয়ে সঞ্চার করতে হবে। এই আবহ গড়ে তোলার কাজ এই সভাকেও করতে হবে, এই পবিত্র মাটিকেও করতে হবে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে যিনি সর্বশেষ ব্রিটিশ কমান্ডার ছিলেন, তিনি বলতেন, ভারত অনেক ক’টি দেশের সমাহারে একটি মহাদেশ। কেউ একে একটি দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না। কিন্তু আপামর ভারতবাসী তাঁর এই আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে। যাঁদের মনে সামান্য সন্দেহ ছিল, তাকেও সমাপ্ত করেছে আমাদের সকলের জিজীবীষা, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্য, আমাদের পরম্পরা আজ বিশ্বের সামনে একটি দেশ রূপে আমাদেরকে দাঁড় করিয়েছে। আর এই দেশ আজ গোটা বিশ্বের সামনে আশার কিরণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমাদের ৭৫ বছরের সাফল্য। কেউ কেউ বলবেন, ভারত একটি আজব গণতন্ত্র; এই ভ্রমও আমরা ভেঙেছি। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে, আমাদের প্রত্যেক ভাবনায়, প্রত্যেক উদ্যোগে এই গণতন্ত্রের ভাবনা ভরপুর। সেজন্য অনেক নির্বাচন এসেছে, শাসন ক্ষমতায় অনেক পরিবর্তন এসেছে, সহজ পরিবর্তন এসেছে, আর পরিবর্তিত শাসন ব্যবস্থাকে আমরা সবাই হৃদয় থেকে স্বীকার করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি।
৭৫ বছরের এই ধারাবাহিকতা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আমাদের বৈচিত্র্যের সাফল্য। কয়েকশ’ ভাষা, কয়েক হাজার কথ্যভাষা, নানা রকম পরিধান, কতো না বৈচিত্র্য, তা সত্ত্বেও আমরা এক লক্ষ্য, এক পথে এগিয়ে দেখিয়েছি। আজ যখন আমরা ভারতের কথা বলি, তখন স্বাভাবিকভাবেই স্বামী বিবেকানন্দের একটি কথা স্মরণ করতে চাইব। তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক জাতির বলার মতো একটি বার্তা থাকে, লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য একটি অভিযান থাকে।” প্রত্যেক দেশের একটি নিয়তি থাকে যা সেই দেশ অর্জন করে। করোনার সময় ভারত যেভাবে নিজেকে সামলেছে, আর বিশ্ববাসীকে সামলাতে সাহায্য করেছে, তা এক ধরনের টার্নিং পয়েন্ট। যে ভাবনা ও শিষ্টাচার নিয়ে বেদ থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ পর্যন্ত আমরা প্রতিপালিত হয়েছি তা হল, “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ। ইয়ে সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ। সর্বে সন্তু নিরাময়া।”
এই করোনা সঙ্কটকালে ভারত এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করেছে। আর দেশ আত্মনির্ভর ভারত রূপে নিজেকে গড়ে তুলতে একের পর এক পদক্ষেপ উঠিয়েছে, দেশের জনসাধারণ এই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আমাদের সেদিনগুলির কথা মনে রাখতে হবে যখন দুটো বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছিল। মানবজাতি ও মানব মূল্য সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। সর্বব্যাপী নিরাশা। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে একটি নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ তৈরি হয়, শান্তির পথে চলার শপথ নেওয়া হয়। সৈন্য নয়, সহযোগিতা – এই মন্ত্র নিয়ে সারা পৃথিবীতে ভাবনা প্রবল হতে থাকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ গড়ে ওঠে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়, নানারকম মেকানিজম গড়ে ওঠে যাতে বিশ্বকে বিশ্বযুদ্ধের পর একটি সুচারুরূপে শান্তির পথে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম হয়। বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সবাই শান্তির কথা বলে, কিন্তু শান্তির কথা বলতে বলতেও ধনী দেশগুলি তাদের সৈন্যশক্তি বাড়াতে থাকে। বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্বে যত সৈন্য ছিল, রাষ্ট্রসঙ্ঘ গড়ে ওঠার পর সেই সৈন্যশক্তি অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। ছোটখাট দেশগুলিও সৈন্যশক্তির প্রতিযোগিতায় নামে। শান্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু বাস্তবে বিশ্বকে এটা মেনে নিতে হবে যে বড় বড় উন্নত দেশগুলি সৈন্যশক্তি বৃদ্ধির দিকে বেশি নজর দিয়েছে। এই সময়ে যত গবেষণা ও উদ্ভাবন হয়েছে তার অধিকাংশই সৈন্যশক্তির জন্য। করোনা-উত্তর সময়েও একটি নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ দেখা যাচ্ছে। করোনা-উত্তর সময়ে বিশ্বে একটি নতুন সম্পর্ক বিন্যাসের আবহ গড়ে উঠছে।
আমাদের ঠিক করতে হবে যে আমরা বিশ্বযুদ্ধের পর যেমন নীরব দর্শক হয়ে উন্নত দেশগুলিকে পরিবর্তিত হতে দেখছিলাম, আর নিজেদেরকে কোনও এক দিকের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলাম, আজও কি সেরকম করব? করোনা-উত্তর বিশ্বে যে নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ তৈরি হওয়া নিশ্চিত। তা কিরকম হবে? কারা এই নতুন ওয়ার্ল্ড অর্ডার তৈরি করার উদ্যোগ নেবে, তা সময় বলবে। কিন্তু যেভাবে বিশ্ব এই সঙ্কটের মোকাবিলা করেছে তাতে বিশ্ববাসী এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছে যে এমন পরিস্থিতিত ভারত থেকে বিযুক্ত হয়ে কেউ থাকতে পারবে না। ভারতকে একটা কোণায় রেখে দিলে চলবে না। ভারতবাসীকেও এক্ষেত্রে বিশ্বে শক্তিশালী জাতি হিসেবে উঠে আসতে হবে। কিন্তু শুধুই জনসংখ্যার জোরে আমরা বিশ্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠার দাবি করতে পারি না। এটা একটা শক্তি অবশ্যই, কিন্তু শুধু এটা দিয়ে চলবে না। নতুন ‘ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এ ভারতকে জায়গা করে নিতে আরও শক্তিশালী, সমর্থ হতে হবে। আর তার উপায় হল আত্মনির্ভর ভারত। আজ ঔষধ শিল্পে আমরা আত্মনির্ভর। আমরা বিশ্বের কল্যাণে কাজে লাগছি। ভারত যত আত্মনির্ভর হবে, আমাদের শিরা-ধমনীতে যেহেতু “সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ” মন্ত্র প্রবাহিত হয়; ভারত যত সামর্থ্যবান হবে, মানবজাতির কল্যাণের জন্য, বিশ্বের কল্যাণের জন্য একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে। আর সেজন্য আমাদের আত্মনির্ভর ভারতের ভাবনাতে জোর দিতে হবে। এটা কোনও শাসন ব্যবস্থার ভাবনা নয়, কোনও রাজনৈতিক নেতার ভাবনা নয়, আজ ভারতের কোণায় কোণায় ‘ভোকাল ফর লোকাল’-এর জয়ঘোষ শোনা যাচ্ছে। এই আত্মগৌরবের ভাবনা আত্মনির্ভর ভারতের জন্য অনেক কার্যকরি প্রমাণিত হচ্ছে। আমাদের সকলের ভাবনা, আমাদের নীতি, আমাদের সিদ্ধান্ত ভারতকে আত্মনির্ভর করে তোলার ক্ষেত্রে যত ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন তা সাধন করতে হবে এটাই আমার মত।
এই আলোচনায় প্রায় সমস্ত মাননীয় সদস্য করোনার কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের জন্য এটা আনন্দ ও গর্বের বিষয় যে করোনার জন্য আমাদের দেশে যত সমস্যা হবে বলে বিশ্ববাসী অনুমান করেছিল, বড় বড় বিশেষজ্ঞরা যেরকম ভেবেছিলেন, যা থেকে ভারতে একটা ভয়ের আবহ গড়ে উঠেছিল, ভারতবাসীকে সেই অজানা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। এত বড় দেশ, এত ঘন জনবসতি, এত কম ব্যবস্থা দেখে বিশ্ববাসীর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিশ্বের বড় বড় দেশগুলি যখন করোনার সামনে নতজানু হতে বাধ্য হয়েছে, সেই সময়ে ১৩০ কোটি ভারতবাসীর নিয়মানুবর্তিতা, সমর্পণ ভাবনা আজ আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এই কৃতিত্ব ১৩০ কোটি ভারতবাসীর। আর আমাদের তাঁদেরই জয়গান করা উচিৎ। বিশ্ব মঞ্চে ভারতের পরিচয় গড়ে তুলতে এটা একটা বড় সুযোগ। আমরা নিজেদের সমালোচনা করে যদি ভাবি বিশ্ব আমাদের স্বীকার করে নেবে, সেটা সম্ভব হবে না। আমরা ঘরে নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে লড়াই করতে পারি, শুধরাতে পারি, কিন্তু বিশ্বের সামনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। তবেই বিশ্ববাসী আমাদের স্বীকার করবে। যদি আপনার ছেলে-মেয়েদের বাড়িতেই স্বীকার না করেন আর চান পাড়ার লোক স্বীকার করবেন, এটা সম্ভব হয় না। এটাই বিশ্বের নিয়ম। আমাদের সেই নিয়ম মেনে চলতে হবে।
শ্রীমান মণীশ তিওয়ারিজি একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে ঈশ্বরের কৃপায় আমরা করোনা থেকে বেঁচে গিয়েছি। আমি তাঁর এই বক্তব্যের ওপর কিছু কথা বলতে চাইব। এটা ঠিক যে ঈশ্বরের কৃপাতেই আমরা এই বিরাট সঙ্কট থেকে রেহাই পেয়েছি, কারণ ঈশ্বর আমাদের দেশে চিকিৎসক এবং নার্সদের ওপর ভর করেছিলেন। তাঁরাই ঈশ্বর রূপে, ত্রাতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁরা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ছেলে-মেয়েদের বলে যেতেন সন্ধ্যায় ফিরব। তারপর ১৫-১৬ দিন ফিরতেনই না। তাঁরাই ঈশ্বরের ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা করোনাকে জয় করতে পেরেছি কারণ আমাদের সাফাই কর্মচারীরা মৃত্যু এবং জীবনের সুক্ষ্ম রেখায় গিয়ে নিজেদের কর্তব্য পালন করেছেন। যে রোগীর কাছে কেউ যেতে পারতেন না, আমার দেশের সাফাই কর্মচারীরা তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করেছেন। অ্যাম্বুলেন্স চালকরা খুব পড়াশোনা জানা মানুষ নন। কিন্তু তাঁরা জানতেন যে যাঁদেরকে নিয়ে যাচ্ছি তাঁরা করোনা পজিটিভ। কিন্তু তাঁরা তাঁদের কর্তব্য পালন করে গেছেন। তাঁদের সেই রূপই ঈশ্বরের রূপ। কিন্তু ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন রূপে এসে আমাদের বাঁচিয়েছেন। তাঁদের যত প্রশংসা করব, যত গৌরবগাথা গাইব, দেশের সাফল্যের গৌরব গান করব ততই আমাদের মনে একটি নতুন শক্তি জন্ম নেবে। অনেক কারণে যাঁদের মনে নিরাশা গ্রাস করেছে, তাঁদেরকেও বলতে চাইব, কিছুক্ষণের জন্য ১৩০ কোটি দেশবাসীর এই পরাক্রমের কথা ভাবুন। আপনাদের মনেও প্রাণশক্তি সঞ্চার হবে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই করোনার সময়টি ছিল আমাদের পরীক্ষার সময়। আর প্রকৃত পরীক্ষা তখনই হয় যখনই সঙ্কট আসে। সাধারণ অবস্থায় তো আমরা সবদিকে লক্ষ্য রাখতে পারি না। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, অনেক দেশ ওই করোনা সময়কালের লকডাউন, কার্ফু এবং আশঙ্কার আবহে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের রাজকোষে পাউন্ড এবং ডলারের পাহাড় জমে থাকা সত্ত্বেও তাদের নাগরিকদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেনি। ব্যাঙ্ক বন্ধ, পোস্ট অফিস বন্ধ, সমস্ত ব্যবস্থা বন্ধ। কিচ্ছু করতে পারেনি। অনেক ইচ্ছা প্রকাশ, অনেক ঘোষণা করেও তারা পারেনি। কিন্তু ভারত এই সঙ্কটকালে প্রায় ৭৫ কোটিরও বেশি দেশবাসীকে রেশন পৌঁছে দিয়েছে। আট মাস ধরে বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। জন ধন, আধার এবং মোবাইলের মাধ্যমে এই সঙ্কটকালেই ২ লক্ষ কোটি টাকা গরীব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দিয়েছে। অথচ একদিন আধারকে আটকানোর জন্য কারা আদালতে গিয়েছিলেন? কারা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন? আমি কখনও অবাক হই, আর আজকে একথা বারবার বলব। অধ্যক্ষ মহোদয় আমাকে ক্ষমা করবেন …
আমাকে ১ মিনিটের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই সভায় কখনও অজ্ঞানতা বড় সমস্যা তৈরি করে দেয়।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
ঠেলাওয়ালা, রেললাইনের দু’ধারে পসরা সাজানো দোকানদাররা যাতে এই করোনা সঙ্কটকালে টাকা পান সেজন্য আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তাতে সফল হয়েছি।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই সঙ্কটের সময়েও আমরা দেশের অর্থনীতিতে সংস্কার প্রক্রিয়া জারি রেখেছি। আমরা যে ভারতের মতো অর্থনীতিকে সঙ্কটমুক্ত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, প্রথমদিন থেকেই আমরা অনেক সংস্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার পরিণামস্বরূপ আজ ট্র্যাক্টর, গাড়ি এসবের রেকর্ড বিক্রি হচ্ছে। আজ জিএসটি-র সংগ্রহ সর্বকালীন উচ্চতা স্পর্শ করেছে। এই সমস্ত পরিসংখ্যান আমাদের অর্থনীতিতে উৎসাহ সঞ্চার করেছে। এটা প্রমাণ করেছে যে নতুন উৎসাহ নিয়ে ভারতের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে, আর এই সাফল্য দেখে বিশ্ববাসী, বিশ্বের বড় বড় বিশেষজ্ঞরা এখন অনুমান করছেন যে এ বছর প্রায় দুই অঙ্কের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবশ্যই হবে। আমিও বিশ্বাস করি, এই সঙ্কটকাল কাটিয়ে উঠতে দেশবাসী যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রেও তাঁরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই করোনার সময়ে আমরা তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করেছি। এই কৃষি সংস্কারের প্রক্রিয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর ধরে আমাদের কৃষিক্ষেত্র বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করছে। সেইসব সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আমরা সেই লক্ষ্যে সততার সঙ্গে একটি চেষ্টা করেছি। অনেক বিদ্বান ও বিশেষজ্ঞরা যেসব সমস্যার কথা বলেছেন, এটা আমার কথা নয়, তাঁরাই বলেছেন যে এই ভবিষ্যতের সমস্যাগুলির এখন থেকেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। আমি দেখছিলাম এখানে যে আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে আমাদের কংগ্রেসের বন্ধুরা যে আলোচনা করেছেন, তাঁরা এই আইনগুলির রং নিয়ে তো অনেক চর্চা করেছেন, কালো কি সাদা, সাদা কি কালো, কিন্তু এর বিষয় নিয়ে চর্চা করলে ভালো করতেন। এর উদ্দেশ্য নিয়ে চর্চা করলে ভালো করতেন। তাহলে দেশের কৃষকদের কাছে সঠিক বার্তাটি পৌঁছত। আর আমার বিশ্বাস, দাদা যে ভাষণ দিয়েছেন, আমার মনে হয় যে দাদা অনেক অনুশীলন করে এসেছেন খুব ভালো করে বলবেন, কিন্তু তিনি খেই হারিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সঙ্গীরা বারবার কেন পশ্চিমবঙ্গ সফর করছেন? এই কথা বলতে গিয়ে তিনি এই কথাতেই জড়িয়ে গেলেন। সেজন্য দাদা নিজস্ব জ্ঞান থেকে যে আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখেন তা থেকে এবার আমরা বঞ্চিত হলাম, আমরা এবার আর সমৃদ্ধ হতে পারিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর যদি আপনার সুযোগ হয় তাহলে আমরা শুনব। আপনি গুরুত্বপূর্ণ এক রাজ্যের প্রতিনিধি। আমরা এই রাজ্যটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি বলেই বারবার যাচ্ছি। আপনারা একে পেছনে ফেলে রেখেছেন বলেই আমরা একে গুরুত্ব দিতে চাইছি। আমরা একটা কথা বুঝি, যেখানে আন্দোলনের প্রশ্ন, দিল্লির বাইরে আমাদের যে কৃষক ভাই-বোনেরা বসে আছেন তাঁরা যে ভুল ধারনার বশবর্তী হয়ে বসে আছেন, যেভাবে গুজবের শিকার হয়েছেন… আরে, আমাকে আমার কথা বলতে দিন। আপনারাও সুযোগ পাবেন ...আপনারা তাঁদের জন্য এমন সব শব্দ বলতে পারেন, যা আমরা বলতে পারি না। আমাদের শ্রী কৈলাশ চৌধুরিজি, দেখুন, আমি আপনাদের কত সেবা করি। আপনারে যেখানে রেজিস্টার করানোর প্রয়োজন ছিল, হয়ে গেল।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
যে কৃষক বন্ধুরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের ভাবনাকে এই সভা এবং আমাদের সরকার সম্মান করে, ভবিষ্যতেও সম্মান করবে। আর সেজন্য সরকারের বরিষ্ঠ মন্ত্রী, যখন এই আন্দোলন পাঞ্জাবে ছিল তখনও তাঁদের কাছে গিয়েছেন, এখনও বারবার তাঁদের কাছে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলছেন। কৃষকদের প্রতি সম্মান জানিয়ে কথা বলছেন।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
লাগাতার আলাপ-আলোচনা চলছে। আবারও বলছি, তাঁরা যখন দিল্লিতে এসেছেন তখনই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়নি, তার আগে থেকেই চলছে। এই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করেছি যে কৃষকদের আশঙ্কা কোথায়? তাঁদেরকে নিয়মিত আশ্বস্ত করেছি যে, আপনাদের প্রত্যেক দাবি নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এ বিষয়ে নরেন্দ্র সিং তোমরজি রাজ্যসভায় বিস্তারিত বলেওছেন। এক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। আমরা মনে করি, এতে যদি সত্যিই কৃষকের লোকসান হয় তাহলে একে না বদলানোর কী আছে? এই দেশ তার নাগরিকদের স্বার্থে যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্ত কৃষকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেজন্য আমরা অপেক্ষা করছি, আজও অপেক্ষা করছি। যদি নির্দিষ্টভাবে কিছু বলেন, আর যদি তা গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে আমাদের পরিবর্তন করতে কোনও আপত্তি কিম্বা সঙ্কোচ নেই। আমরা অধ্যাদেশের মাধ্যমে তিনটি আইন চালু করেছিলাম, তারপর এগুলি সংসদে পাশ করা হয়েছে। আইন প্রযোজ্য হওয়ার পর দেশে কোথাও মান্ডি বন্ধ হয়নি, কোথাও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনাও বন্ধ হয়নি। এটাই সত্য। শুধু তাই নয়, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার পরিমাণ বেড়েছে। এই নতুন আইন বাস্তবায়িত হওয়ার পর অনেক বেড়েছে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই হৈহল্লা, এই চিৎকার, এই বাধা দেওয়ার প্রচেষ্টা একটি পূর্ব পরিকল্পিত রণনীতির ফলে করা হচ্ছে। এটা আগে থেকে ভাবনা-চিন্তা করে ঠিক করা হয়েছে। নাহলে যে গুজব ছড়ানো হয়েছে তার পর্দা ফাঁস হয়ে যাবে। সত্য সেখানে পৌঁছে যাবে। সত্য যদি সেখানে পৌঁছে যায় তাহলে তাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়বে। সেজন্যই এই হৈ-হট্টগোল। বাইরে যেমন হৈ-হট্টগোল করছিলেন, তেমনই সংসদের ভিতরেও এই হৈ-হট্টগোল খেলা তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এর মাধ্যমে আপনারা কখনও অন্য সাংসদদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবেন না।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
আমি কৃষকদের কাছে জানতে চাই, অধ্যাদেশের পর এবং সংসদে আইন পাশ হওয়ার পর তাঁরা যে ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি ও ফসল বিক্রির কাজ করছিলেন তাতে কি কোনও পার্থক্য এসেছে? নতুন এই আইন কি আপনাদের কোনও অধিকার কেড়ে নিয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব কারোর কাছে নেই। সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু একটি অতিরিক্ত বিকল্প ব্যবস্থা তাঁরা পেয়েছেন, সেটাও বাধ্যতামূলক নয়। কোনও আইনের বিরোধিতা তখনই সদর্থক হতে পারে, যখন সেটি বাধ্যতামূলক হয়। কিন্তু এই আইন তো বাধ্যতামূলক নয়! আপনারা যেখানে ইচ্ছে ফসল বিক্রি করুন, যেখানে বেশি লাভ পাবেন সেখানে যাতে কৃষক যেতে পারেন, এই আইনে শুধু সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। আর সেজন্য …
… কিন্তু অধীর রঞ্জনজি এখন বাড়াবাড়ি হচ্ছে। …প্লিজ! আমি আপনাকে সম্মান করি। আর আমি আগেই বলেছি, আপনারা যতটা বলেছেন, সেটা তো এখানে নথিভুক্ত হয়েছে।… ... আর পশ্চিমবঙ্গেও টিএমসি-র থেকে বেশি প্রচার আপনি পাবেন।… তাহলে দাদা এত কেন?
অধ্যক্ষ মহোদয়, এই যে আইন, তা কাউকে বেঁধে রাখার জন্য নয়।এই আইনের মাধ্যমে তাঁদের জন্য বিকল্প তৈরি করা হয়েছে, আর বিকল্প কোনও বিরোধিতার কারণ হতে পারে না। কোনও আইন যদি কারোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলেই বিরোধিতা করা যেতে পারে। আমি দেখছি আন্দোলনের একটি নতুন পদ্ধতি। কেমন পদ্ধতি? আন্দোলনকারীরা কখনও এমন পদ্ধতি মেনে চলেন না। আন্দোলনজীবীরাই এই ধরনের পদ্ধতি তৈরি করেন, অনুসরণ করেন। আর তাঁরা বলেন, এমন হলে তেমন হবে। আরে ভাই! যা হয়ইনি, যা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই, তা নিয়ে ভয় সৃষ্টি করা কেন? বিগত কয়েক বছর ধরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিয়মিত একটি রায় আসছে, কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আপনারা ঝড় তুলে দিলেন, সারা দেশে আগুন লাগিয়ে দিলেন। এই যে পদ্ধতি … যাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস রাখেন, যাঁরা অহিংসায় বিশ্বাস রাখেন, তাঁদের সকলের জন্য চিন্তার বিষয় এই পদ্ধতি। এটা সরকারের চিন্তার বিষয় নয়। দেশের চিন্তার বিষয় নয়।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
পুরনো মান্ডিগুলির ওপর কোনরকম বাধা-নিষেধ সৃষ্টি করা হয়নি। উপরন্তু এবারের বাজেটে এই মান্ডিগুলিকে আধুনিক করে তোলার জন্য, তাদের পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। আর সেই বাজেটের মাধ্যমেই, মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, আমাদের এই সিদ্ধান্ত যা “সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়” ভাবধারা থেকে নেওয়া হয়েছে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই সভার সদস্যরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন, কংগ্রেস এবং কয়েকটি দলের প্রতিনিধিরা তাঁদের বক্তব্যে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। কিন্তু যে বিষয়গুলি নিয়ে তাঁদের বলা উচিৎ ছিল সেগুলি নিয়ে বলেননি। প্রত্যাশা ছিল যে তাঁরা একটু পড়াশোনা করে আসবেন। শুধু তাই নয়, এই প্রথম আমি অবাক হয়ে শুনলাম যে লোকসভায় দাঁড়িয়ে কেউ বলছেন, আমরা যেটা চাইনি তা আমাদের দিলেন কেন?
আমার জবাব হল, নেওয়া না নেওয়া আপনাদের ইচ্ছে। কেউ আপনার গলায় ঝুলিয়ে দেয়নি। বাধ্যতামূলক নয়। এটা একটা বিকল্প ব্যবস্থা। আমাদের দেশ অনেক বড়। দেশের কিছু জায়গায় এর মাধ্যমে লাভ হবে। আবার হতে পারে কারোর লাভ হবে না। কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক নয়। সেজন্য এখানে চাওয়া-পাওয়ার কোনও ব্যাপারই নেই। কিন্তু তবুও আমি বলতে চাই অধ্যক্ষ মহোদয়, এ দেশে পণ প্রথার বিরুদ্ধে আইন হয়েছে। কেউ এটা নিয়ে কখনও দাবি জানায়নি, কিন্তু আইন করা হয়েছে। দেশের উন্নতির জন্য এই আইন করা হয়েছে। তিন তালাক নিয়ে কেউ দাবি জানায়নি, কিন্তু প্রগতিশীল সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় বলে আমরা এই আইনও তৈরি করেছি। আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ রোধে আইন তৈরি করার দাবিও কেউ রাখেনি, কিন্তু প্রগতিশীল সমাজের প্রয়োজনে আইন করা হয়েছে। বিয়ের বয়স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েও কেউ দাবি জানায়নি, কিন্তু প্রগতিশীল ভাবনা থেকে এই সিদ্ধান্ত আইনে পরিণত হয়েছে। মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার সুনিশ্চিত করার আইন প্রণয়নের দাবিও কেউ রাখেনি। কিন্তু প্রগতিশীল সমাজের প্রয়োজনে আইন করা হয়েছে। শিক্ষার অধিকার শিক্ষার অধিকার দেওয়ার জন্য আইন তৈরি করার দাবিও কেউ রাখেনি, কিন্তু প্রগতিশীল সমাজের প্রয়োজনে আইন করা হয়েছে। এই যে এত আইন করা হয়েছে, পরিবর্তিত সমাজ এগুলিকে স্বীকার করেছে কি করেনি, তা গোটা বিশ্ব জানে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
আমরা এটা মানি যে ভারতের অনেক পুরনো রাজনৈতিক দল কংগ্রেস পার্টি, যারা প্রায় ছয় দশক এ দেশে একছত্র শাসন করেছে, সেই দলের কি অবস্থা হয়েছে। রাজ্যসভায় দলের নেতারা এক ধরনের কথা বলেন, আবার লোকসভায় অন্য ধরনের কথা বলেন। এমন বিভাজিত দল, এমন বিভ্রান্ত দল নিজেরও ভালো করতে পারে না, দেশের সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু ভাবতেও পারে না। এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! রাজ্যসভাতেও কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতারা বসে আছেন। তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ এবং উৎসাহের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন, বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য রাখেন। আর এখানে কংগ্রেসের অন্য গোষ্ঠী … ঠিক আছে, এটা সময় বলবে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
আমরা জানি, কখনও কখনও এমন মামলা সামনে আসে, যখন আমরা ২০১৪-য় দেশের শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব নিই, তখন ইপিএফ পেনশন প্রকল্পে কেউ ৭ টাকা পেতেন, কেউ ২৫ টাকা, কেউ ৫০ টাকা আবার কেউ ২৫০ টাকা। আমি বলি, পেনশন নিতে যাওয়ার সময় যে অটোরিক্সর ভাড়া লাগে, সেই টাকাটাও তাঁরা অনেকে পেতেন না। এজন্য আইন তৈরি করার দাবিও কেউ রাখেননি, কোনও শ্রমিক সংগঠনও আমার কাছে আবেদনপত্র দেয়নি। মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, কেউ না চাইলেও আমরা আইন সংশোধন করে ন্যূনতম পেনশন ১,০০০ টাকা করার সিদ্ধান্ত নিই। কোনও কৃষক সংগঠন আমার কাছে এরকম কোনও দাবি জানায়নি যে, ছোট কৃষকদের কিছু সাম্মানিক দেওয়া হোক। কিন্তু আমরা ‘প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মান নিধি যোজনা’র মাধ্যমে তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা দিতে শুরু করেছি।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
যে কোনও আধুনিক সময়ের জন্য পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমরা দেখেছি যেভাবে আমাদের সেই সময়ে বিরোধিতা হত তাকে অগ্রাহ্য করে রাজা রামমোহন রায়জির মতো মহাপুরুষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জ্যোতিবা ফুলে কিংবা বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো অসংখ্য মহাপুরুষ সমাজের চাহিদার বিরুদ্ধে গিয়ে সমাজ সংস্কার করেছেন। ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য আপ্রাণ লড়াই করেছেন। তবেই সমাজ এগিয়েছে। এরকম দায়িত্ব আজও নিতে হবে। বিরোধিতা হবে। যখন সত্যটা প্রমাণিত হবে, মানুষ সত্যটা বুঝতে পারবেন, তখন একে স্বীকারও করে নেবেন। ভারত এত বড় দেশ। যে কোনও সিদ্ধান্ত সবাই ১০০ শতাংশ মেনে নেবে, এটা সম্ভব নয়। এই দেশ বৈচিত্র্যময়। দেশের এক জায়গার মানুষ এই আইনের মাধ্যমে বেশি লাভবান হবেন, অন্য জায়গায় কম হবে। কোনও জায়গায় হয়তো আগে থেকেই লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু একটি বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। “সর্বজন হিতায়, সর্বজন সুখায়” মনোভাব নিয়েই আমরা এ ধরনের কাজ করি।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এই ভাবনাটাই ভুল যখন বলা হয়, আমরা তো চাইনি, তাহলে দিলেন কেন? আমরা কি এখনও সামন্ত শাসনে রয়েছি যে দেশের জনগণ যাচকের মতো আমাদের কাছে চাইবেন? আমরা কি তাঁদেরকে চাওয়ার জন্য বাধ্য করব? এই চাওয়ার জন্য বাধ্য করার ভাবনা গণতান্ত্রিক ভাবনা হতে পারে না। মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, সরকারকে সংবেদনশীল হতে হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষের ভালোর জন্য সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আর সেজন্য এ দেশের জনগণ আয়ুষ্মান যোজনা না চাইলেও আমাদের যখন মনে হয় গরীব মানুষকে অসুখ-বিসুখ থেকে বাঁচাতে হবে, তখন আমাদের এই ‘আয়ুষ্মান ভারত যোজনা’ চালু করতে হয়। এ দেশের গরীবরা তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য কোনও মিছিল বের করেননি, কোনও দাবিপত্র জমা দেননি। কিন্তু আমরা দেশের অধিকাংশ মানুষকে দেশের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য জন ধন যোজনা চালু করেছিলাম এবং তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
কেউ আমাদের কাছে ‘স্বচ্ছ ভারত’এর দাবি জানাননি। কিন্তু আমরা যখন দেশের সামনে ‘স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প’ নিয়ে আসি তখন তা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। কেউ কি আমাদের বলেছিলেন যে, আমাদের বাড়িতে শৌচালয় তৈরি করে দিন! কিন্তু আমরা ১০ কোটি মানুষের বাড়িতে শৌচালয় নির্মাণের কাজ করেছি। সেদিন চলে গেছে যখন চাইলে পরে সরকার কাজ করত। এটা গণতন্ত্র, এটা সামন্ততন্ত্র নয়। আমাদের জনগণের প্রয়োজনীয়তা বুঝে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে তাঁদের জন্য কাজ করতে হবে। নাগরিকদের যাচক বানিয়ে আমরা তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারব না। নাগরিকদের অধিকার প্রদানের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যাচক হলে নাগরিকদের আত্মবিশ্বাস কমে যাবে। তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে, তাঁদের মধ্যে সামর্থ্য তৈরি করতে যে যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ আমরা সেই লক্ষ্যে পদক্ষপে নিয়েছি। সরকার … দাদা দাদা, এক মিনিট শুনুন, আমি সেই বিষয়ে আসছি।… যাঁরা চাননা তাঁদের জন্য পুরনো ব্যবস্থা আছে। এইটুকু কথা আপনাদের মতো বুদ্ধিমান মানুষদের আমাকে বোঝাতে হচ্ছে বলে আমি অবাক হচ্ছি। যাঁরা চাননা তাঁদের জন্য তো পুরনো ব্যবস্থা আছে! পুরনো ব্যবস্থা তো অবলুপ্ত হয়নি!
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
একটা কথা আমরা সবাই জানি, জমা জল থেকে নানারকম রোগ হয়। আর যে জলে স্রোত থাকে তা জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলে, উদ্দীপনায় ভরিয়ে তোলে। যা চলছে তাকে চলতে দিতে হয়। আরে ভাই, দায়িত্ব নিতে হয়। দেশের প্রয়োজন অনুসারে সিদ্ধান্তও নিতে হয়। স্টেটাস কো… - এই একটা মানসিকতা আমাদের দেশের সর্বনাশ করার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। পৃথিবী বদলাচ্ছে। কতদিন পর্যন্ত আমরা স্টেটাস কো, স্টেটাস কো, স্টেটাস কো – এরকম বলতে থাকব? কেউ কেউ যদি মনে করেন যে পরিস্থিতি বদলাবে না, তাদের জন্য দেশের নবীন প্রজন্ম বেশিদিন অপেক্ষা করতে পারে না।
কিন্তু আজ আমি একটি ঘটনা শোনাতে চাই। এ থেকে আমরা সকলেই বুঝতে পারব যে স্টেটাস কো-র ফলে কী হয়। ৪০-৫০ বছর পুরনো একটি ঘটনা। আমি কারোর কাছ থেকে শুনেছি, সেজন্য তারিখ একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। আমি স্মৃতি থেকে বলছি। ষাটের দশকে তামিলনাড়ুতে কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর জন্য যে কমিশন বসেছিল, সেই কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে একটি টপ সিক্রেট চিঠি আসে। তিনি খুলে দেখেন যে এর মধ্যে একটি আবেদন রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে – “আমি অনেক বছর ধরে এই ব্যবস্থায় কাজ করছি। আমি সততার সঙ্গে কাজ করছি, কিন্তু আমার বেতন বাড়ছে না। আমার বেতন বাড়ানো হোক।” যিনি চিঠিটি লিখেছেন তাঁকে চেয়ারম্যান জবাবে লেখেন আপনি কে? কোন পদে কাজ করেন? ইত্যাদি। তখন সেই ব্যক্তি আবার জবাব দেন, “আমি সরকারের মুখ্য সচিবের অফিসে সিসিএ পদে কাজ করছি।” এই জবাব পেয়ে চেয়ারম্যান ভাবেন এই ‘সিসিএ’ আবার কি? এরকম তো কোনও পদ নেই। তখন তিনি আবার চিঠি লেখেন, ‘ভাই, সিসিএ শব্দ তো কোথাও দেখিনি, পড়িওনি। এটা কি আমাকে জানান!’ তখন সেই ব্যক্তি আবার জবাব দেন, ‘স্যার আমি আইনে বাঁধা। ১৯৭৫-এর পরই এ বিষয়ে কথা বলতে পারব, এখন বলতে পারব না’! তখন চেয়ারম্যান আবার লেখেন, ‘তাহলে আপনি ১৯৭৫-এর পর যে কমিশন বসবে তাদের কাছেই যাবেন, আমার মাথা কেন খাচ্ছেন?’ তখন সেই ব্যক্তি ভাবেন যে, এ তো ঝামেলা হয়ে গেল!’ এবার তিনি জবাব দেন, ‘আমি আপনাকে বলছি, সিসিএ-র অর্থ হল চার্চিল সিগার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমি এই সিসিএ পদে কাজ করি’। এই সিসিএ পদটি কী? ১৯৪০-এ যখন চার্চিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন ত্রিচি থেকে তাঁর জন্য সিগার যেত। আর এই সিসিএ-র কাজ ছিল সিগার তাঁর কাছে ঠিকঠাক পৌঁছল কিনা তা নিশ্চিত করা। সেজন্য এই পদ তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৪৫-এ চার্চিল নির্বাচনে হেরে যান, কিন্তু তারপরও সেই পদ রয়ে গেছে আর সিগারের সরবরাহও জারি রয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, এই পদ বাতিল হয়নি। চার্চিলকে সিগারেট পৌঁছনোর দায়িত্বসম্পন্ন একটি পদ মুখ্য সচিবের অফিসে তখনও বজায় রয়েছে। আর সেজন্য তিনি নিজের বেতন এবং প্রোমোশনের জন্য চিঠি লিখেছেন।
এখন দেখুন, এ ধরনের স্টেটাস কো যদি আমরা পরিবর্তন না করি, ব্যবস্থাকে যদি খতিয়ে না দেখি, তাহলে এর থেকে বড় হাস্যকর উদাহরণ আর কী হতে পারে? আমি যখন মুখ্যমন্ত্রী হলাম, তখন একটি প্রতিবেদন রোজ আসত যে, ‘আজ কোনও বেলুন আসেনি, আর কোনও চিরকূট ফেলা হয়নি’। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই প্রতিবেদনের প্রথা চালু হয়েছিল, তা এখনও চলছে। অর্থাৎ এই ধরনের স্টেটাস কো আমাদের ব্যবস্থায় ঢুকে রয়েছে। আমরা যদি ভাবি ভাই ফিতে কাটব, প্রদীপ জ্বালাব, ফটো তোলা হবে, আর আমাদের কাজ হয়ে গেল, দেশ এভাবে চলতে পারে না। আমাদের দায়িত্ব নিয়ে দেশে পরিবর্তনের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করতে হবে। ভুল হতে পারে। কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে পরিণামও ভালো হবে। হতে পারে দু-একটা ক্ষেত্রে আমরা নিস্ফল হবো। আপনারা দেখুন, আমাদের দেশে একটা সময় ছিল যখন যে কোনও শংসাপত্র প্রত্যয়িত করাতে হত। কোনও গেজেটেড অফিসার, কাউন্সিলর বা এমপি-এমএলএ-র বাড়ির সামনে লাইন লাগত। যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা একটা ছাপ না দিতেন … মজার ব্যাপার হল, সেই ছাপটাও তাঁরা মারতেন না। একটা ছেলে বাইরে বসে থাকত, সেই ছাপ মারত। এই ব্যবস্থাই চলছিল। আমরা সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর বলি, এই ব্যবস্থার কী মানে? আমাদের দেশের জনগণের ওপর ভরসা রাখতে হবে! আমরা এই প্রথাই তুলে দিয়েছি। এতে দেশের জনগণের লাভ হয়েছে। আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে, সংস্কার আনতে হবে। আমাদের দেশে যেভাবে ইন্টারভিউ হত, আমি তা দেখেও অবাক হতাম। এক ব্যক্তি দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেন, ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য প্যানেলে তিনজন বসে থাকতেন। তাঁরা অনেক সময় তাঁর পুরো নামও জিজ্ঞাসা না করে বলতেন যে, তোমার ইন্টারভিউ হয়ে গেছে। যাঁদেরকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে আগেই তাঁরা ভেবে রেখেছেন, তাঁরাই চাকরি পেত। তাহলে এই প্রথার মানে কী? একজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য যোগ্যতা মেধার ভিত্তিতে কম্পিউটারের কাছে জিজ্ঞাসা করুন, জবাব পেয়ে যাবেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়োগের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তাহলে এই ইন্টারভিউ-এর প্রয়োজন কেন? আমরা ওই পদ্ধতি বাতিল করার পর আগে যে সুপারিশ ছাড়া চাকরি হত না, সেই ব্যবস্থাটাই উঠে গেছে। আমি মনে করি, আমাদের এভাবেই দেশে সমস্ত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন রয়েছে। পরিবর্তনে অসাফল্যের ভয়ে আটকে থাকা, এই প্রবৃত্তি কখনও কারোর ভালো করতে পারে না। আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে এবং পরিবর্তনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
আমাদের দেশে চাষবাস এবং কৃষকরা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মূল স্রোতের অংশ। এক প্রকার আমাদের দেশের সংস্কৃতি প্রবাহের সঙ্গে আমাদের কৃষি জুড়ে রয়েছে। আমাদের ঋষি-মুনিরা এই নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। কৃষি সম্পর্কে আমাদের দেশে অনেক গ্রন্থ রয়েছে, অনেক ভালো অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। আর আমাদের দেশের রাজারাও ফসলের খেতে হাল চালাতেন। জনক রাজার কথা তো আমরা জানিই। ভগবান কৃষ্ণের ভাই বলরামের কথাও আমরা জানি। আমাদের দেশে যে কোনও বড় পরিবারে কৃষক এবং চাষবাস, এটা আমাদের দেশে নিছকই ফসল ফলানো নয়, আমাদের দেশে কৃষি এক প্রকার সমাজ জীবনের সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল। আর সেই অঙ্গ নিয়েই আমাদের যত কিছু। এটাই আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের উৎসব-অনুষ্ঠান, আমাদের পালা-পার্বন, আমাদের জয় – সবকিছু ফসল বপনের সময় আর ফসল কাটার সময়ের সঙ্গে যুক্ত। এটাই আমাদের দেশের পরম্পরা। আমাদের দেশে যত লোকগীত রয়েছে তা কৃষি এবং ফসলের সঙ্গে যুক্ত। সেজন্য উৎসবগুলিও কৃষির সঙ্গে যুক্ত। আমাদের দেশে কাউকে আশীর্বাদ দিলে বা শুভকামনা জানালে তার সঙ্গে ধনধান্য শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তার মানে আমাদের পূর্বজরা ধন এবং ধান্যকে আলাদাভাবে দেখতেন না। শুধু ধান্য কোনও শব্দ হয় না, শুধু ধনও হয় না। ধনধান্য বলা হয়। আমাদের দেশে এই ‘ধন’এর সঙ্গে জুড়ে থাকা ‘ধান্য’ শব্দটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের সমাজ জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে আবার পথে ফিরিয়ে আনতে সমাজ জীবনের এই অংশকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
রাজ্যসভায় আমি বিস্তারিতভাবে এই ছোট কৃষকদের সম্পর্কে বলেছি। এখন দেশের ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষকে উপেক্ষিত রেখে আমরা দেশের ভালো করতে পারব না। তাঁদের জন্য আমাদের কিছু ভাবতেই হবে, আর অত্যন্ত নম্রতার সঙ্গে ভাবতে হবে। আর আমি গুণে গুণে বলেছি, ছোট কৃষকরা কিভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছেন। তাঁদের নামে কী কী হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা জরুরি। আর আপনাদেরকেও পরিবর্তিত হতে হবে। এই ছোট কৃষকরা যদি জেগে ওঠেন, তাহলে আপনাদেরও জবাব দিতে হবে। এটা আমি খুব ভালোভাবে বুঝি। আমাদের দেশে যেভাবে জনসংখ্যা বাড়ছে, মাথাপিছু জমির টুকরো ছোট হয়ে চলেছে। পরিবারের হাতে যে জমি আছে তা ক্রম-বিভাজিত হয়ে চলেছে। চৌধুরি চরণ সিং-জি এক জায়গায় এটা বলেছিলেন, “আমাদের দেশে কৃষকরা যত জমির মালিক ছিলেন সেই জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। একটা পরিস্থিতি এমন আসবে যে নিজের খেতেই ট্যাক্টর ঘোরাতে হলে সেটা ঘোরানোর জায়গায় থাকবে না। এত ছোট জমির টুকরো হয়ে পড়বে।” এতদিন আগে আমাদের মহাপুরুষরা যখন এভাবে ভেবেছেন, তখন আমাদেরও কিছু না কিছু ব্যবস্থা তো করতে হবে!
স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে ২৮ শতাংশ কৃষকরা ছিলেন কৃষি মজুর। ১০ বছর আগে যে জনগণনা হয়েছে সেখানে দেখা গেছে, কৃষকদের মধ্যে খেত মজুরের সংখ্যা ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়ে পড়েছে। এটা যে কোনও দেশের জন্য চিন্তার বিষয় হওয়া উচিৎ। জমি কম হলে চাষ থেকে যে ‘রিটার্ন’ পাওয়া উচিৎ, তা না পাওয়ার ফলে তাঁদের জীবনে সমস্যা আসছে। আর তাঁরা অন্যের খেতে গিয়ে খেত মজুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন দুর্ভাগ্য হল, আমাদের দেশে চাষের পেছনে যতটা অর্থ বিনিয়োগ হওয়া উচিৎ সেটা হচ্ছে না। সরকার এতটা করতে পারছে না … রাজ্য সরকারগুলিও করতে পারছে না, আর কৃষকরা নিজেরাও তা করতে পারছেন না। ফসল বিক্রি করে তাঁরা যে টাকা পান তা সংসার প্রতিপালন করতে আর খাওয়ার পেছনেই ফুরিয়ে যায়। সেজন্যই কৃষিতে বিনিয়োগের অনেক বড় প্রয়োজন রয়েছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিনিয়োগ আনতে পারব না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কৃষিকে আধুনিক করে তুলতে পারব না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম কৃষকদের হিতে আমাদের ব্যবস্থাকে বিকশিত করতে পারব না, আমরা ততদিন দেশের কৃষিক্ষেত্রকে শক্তিশালী করে তুলতে পারব না। সেজন্য আমাদের কৃষকদের আত্মনির্ভর করে তুলতে, তাঁরা যেন নিজের ফসল ইচ্ছামতো জায়গায় বিক্রি করতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর আমাদের কৃষকরা যদি শুধুই গম আর চালে সীমাবদ্ধ থাকেন, তাহলে তো আমাদের চলবে না। বিশ্বে কোন কোন ফসলের বাজার রয়েছে আজ তা নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা হচ্ছে। কৃষকদের সেই ধরনের ফসল উৎপাদন করতে হবে যার চাহিদা বিশ্বের বাজারে বেশি রয়েছে। দেশের জন্য যত ধরনের ফসলের প্রয়োজন তাও যেন আমাদের বাইরে থেকে না আনতে হয়। আমার মনে পড়ে, যখন অনেক আগে আমি সংগঠনের কাজ করতাম, উত্তরভাগে আমার ফারুক সাহেবের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তখন আমাকে হরিয়ানার এক কৃষক নিজের খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর এক-দেড় বিঘা জমি ছিল। তাঁর অনুরোধে আমি দেখতে গেলাম। প্রায় ৩০-৪০ বছর আগের কথা। ৩০ বছর তো হবেই। সেই ভদ্রলোক কী করেছেন, দিল্লির ফাইভ স্টার হোটেলগুলিতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছেন, কোন সব্জিগুলি তাঁরা বিদেশ থেকে আনেন। দেখা গেল, তাঁদের প্রয়োজন বেবি কর্ন, ছোট টোম্যাটো ইত্যাদি। সেই ছোট কৃষক নিজের ছোট্ট জমিতে ওই ফসলগুলি ফলালেন আর দিল্লির ফাইভ স্টার হোটেলগুলিতে নিয়ে গিয়ে সেগুলি বিক্রি করতে শুরু করলেন। এভাবে আমরাও দেশে চাষের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পারি। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি? যেমন স্ট্রবেরি। আমরা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে স্ট্রবেরি শীতল প্রদেশে হয়। কিন্তু আমাদের কিছু কৃষক গত কয়েক বছর ধরে কচ্ছ-এর মরুভূমিতে স্ট্রবেরির চাষ করছেন, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে স্ট্রবেরি চাষ করছেন, এমনকি বুন্দেলখন্ডে, যেখানে জলের অনেক সমস্যা সেখানেও চাষ করছেন। তার মানে কী হল? আমাদের দেশে সম্ভাবনা আছে। আমাদের কৃষকদের সঠিক পথ দেখিয়ে তাঁদেরকে নতুন নতুন ফসল ফলানোর দিকে নিয়ে যাওয়া যায়। আমি অবশ্যই মনে করি আমাদের দেশের কৃষকরা এগিয়ে এলে এটা তাঁরা পারবেন। অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা বলে, এক্ষেত্রে তাঁদেরকে প্রতিনিয়ত সাহস জোগাতে হবে, তাঁদের হাত ধরতে হবে, আর যদি তাঁরা একবার লাভবান হন, তাহলে তাঁরা আপনাদের অবাক করে দিতে পারেন। একইভাবে, কৃষিতে যত বেশি নতুন বিনিয়োগ আনতে পারব, তা কৃষিতে কর্মসংস্থানও বাড়াবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা নতুন নতুন বাজার পেতে পারি।
আমাদের দেশে গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করতে পারলে কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের সম্ভাবনা বাড়বে। আর সেজন্য আমাদের এই সম্পূর্ণ কৃষি ক্ষেত্রটিকেই আত্মনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। অনেক কঠিন পরিস্থিতিতেও আমাদের কৃষকরা রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন করেছেন। করোনার সংকট কালেও তাঁরা সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন। এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব, এমন কিছু করতে হবে যাতে আমাদের কৃষকদের সমস্যা অনেক হ্রাস পায় আর সেই লক্ষ্যেই আমাদের করা কৃষি সংস্কারগুলি তাঁদের জন্য নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে। আমরা কৃষকদের একটি বিকল্প পথ দেখাতে পারব, আধুনিক প্রযুক্তি দিতে পারব, এগুলির মাধ্যমে তাঁদের মনে নতুন আত্মবিশ্বাস জাগাতে পারব। সেই লক্ষ্যে ইতিবাচক ভাবনার অনেক প্রয়োজন রয়েছে। পুরনো ভাবনা, পুরনো মাপকাঠি যদি কৃষকের উন্নতি করতে পারত, তাহলে অনেক আগেই পারত। আমরা দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লবের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা একটা নতুন পদ্ধতি নেব আর এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই মিলে চিন্তাভাবনা করব। এক্ষেত্রে রাজনীতি যেন প্রতিবন্ধক না হয়ে ওঠে। দেশের ভালোর জন্য এভাবেই এগুলির প্রয়োজন। আমাদের মিলেমিশে সেই লক্ষ্যে চিন্তাভাবনা করতে হবে। যে দল ক্ষমতায় আছে আর যারা বিপক্ষে আছেন, আমাদের সকলের দায়িত্ব যে একবিংশ শতাব্দীতে আমরা যেন আমাদের কৃষিক্ষেত্রকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ভাবনা দিয়ে পরিচালিত না করি।
আমাদের কৃষকরা দারিদ্র্যের পাঁকে নিমজ্জিত থাকুন এটা কেউ চায় না। এখানে যাঁরা আছেন, সবাই নিশ্চয়ই চান যে কৃষকরা যেন তাঁদের জীবনে নিজেদের মতো করে বাঁচার অধিকার পান। তাঁরা যেন আশ্রিতের মতো, পরাধীনের মতো না বাঁচেন। তাঁরা যেন সরকারের দয়ায় বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য না হন। এই দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এই দায়িত্ব পালন করলেই আমাদের অন্নদাতারা সমৃদ্ধ হবেন, তাঁরা দেশকে কিছু না কিছু বেশি দিতে পারবেন। সেজন্য আমাদের উচিৎ তাঁদেরকে সুযোগ দেওয়া।
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল একটা কথা বলতেন, “স্বাধীনতা পাওয়ার পরও যদি পরজীবিতার দুর্গন্ধ আসতে থাকে, তাহলে স্বাধীনতার সুরভি কখনও ছড়াতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ক্ষুদ্র কৃষকরা নতুন অধিকার না পাবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থাকবে। আর সেজন্য বড় পরিবর্তন এনে আমাদের নিজেদের কৃষকদের একটি দীর্ঘ যাত্রাপথের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আর এটা আমাদের সবাইকে মিলেমিশে করতে হবে। ভুল কিছু করার ভাবনা নিয়ে এটা সম্ভব নয়। ভালো কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে করতে হবে, কারোর ভালো করার ইচ্ছা নিয়ে করতে হবে।”
আমাদের সরকার ছোট কৃষকদের জন্য সবরকম চেষ্টা করবে। বিগত ছয় বছরে তাঁদের জন্য আমরা বীজ থেকে বাজার পর্যন্ত অনেক এমন পদক্ষেপ নিয়েছি যা তাঁদের কাজে লাগবে। যেমন ডেয়ারি ক্ষেত্র এবং সমবায় ক্ষেত্রে। এগুলির সশক্তিকরণ তাঁদেরকে একটি শক্তিশালী মূল্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে উপকৃত করেছে। এক্ষেত্রে সরকারের দখলদারি ন্যূনতম। তা সত্ত্বেও এই দুটি ক্ষেত্র শক্তিশালী হতে পেরেছে। এই প্রক্রিয়া আমরা ধীরে ধীরে ফুল-ফল-সব্জির দিকেও নিয়ে যেতে পারি। আর তারপর আমরা ধানের দিকে নজর দিতে পারি। এভাবে আমরা কৃষকদের অনেক শক্তিশালী করে তুলতে পারি। আমাদের সামনে সফল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এই সফল দৃষ্টান্তকে আমাদের প্রয়োগ করা উচিৎ। আমাদের তাঁদেরকে বিকল্প বাজারের সুযোগ দেওয়া উচিৎ।
আমরা দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছি সেটি হল ১০ হাজার কৃষকের প্রোডিউসার্স অর্গানাইজেশন বা এফপিও। এটি ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য একটি বড় শক্তি রূপে উঠে আসতে চলেছে। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে এই এফপিও তৈরির প্রয়োগ বেশি হয়েছে। আরও কয়েকটি রাজ্যে হয়েছে। কেরলে কমিউনিস্ট পার্টি এফপিও তৈরির জন্য অনেক কাজ করেছে। কিন্তু সেজন্য কৃষকদের নিজেদের উদ্যোগে মিলিত শক্তি রূপে উঠে আসতে হবে। এই ১০ হাজার কৃষকের এফপিও তৈরি হওয়ার পর আপনারা দেখবেন যে গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকরা, তাঁদের বাজারের শক্তিকে কিভাবে ‘ডিক্টেট’ করবেন। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এভাবে কৃষকরা সমাজে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন। এই এফপিও-গুলির মাধ্যমে তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে পারেন। তাঁরা ছোট ছোট ফসল সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা করতে পারেন। আরেকটু শক্তি জোগাড় করতে পারলে তাঁরা ছোট ছোট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণাগারও তৈরি করতে পারেন। আমরা কৃষিতে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য ১ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছি। আর আমাদের দেশে এখন প্রায় ৭ কোটি বোন বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। গ্রামে বসবাসকারী এই বোনেরা তো আসলে কৃষকদেরই মেয়ে। কোন না কোনও চাষের সঙ্গে যুক্ত পরিবারেরই মেয়ে। সেজন্য আজ এই নেটওয়ার্ক কৃষকদের উপকারে লাগছে। আর এই স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি ক্রমে দেশে অর্থনৈতিক গতিবিধির কেন্দ্র হয়ে উঠছে। আমার মনে পড়ে, গুজরাটের ভলসার জেলায় আদিবাসীদের কাছে অনেক উঁচু-নিচু জমিতে আমরা একটা প্রকল্প করেছিলাম। আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামজি একবার তাঁর জন্মদিন পালন করতে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, ভাই, কোনও প্রোটোকল চাই না। আমি এই কৃষকদের সঙ্গে থাকতে চাই। অনেক সফল প্রয়োগ ছিল। সেই আদিবাসী অঞ্চলে মহিলারা অনেক কাজ করতেন। মাশরুম, কাজু ইত্যাদি উৎপাদন করতেন। সেই সময়ের মধ্যেই তাঁরা কাজু উৎপাদনে গোয়ার সমকক্ষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। আর তাঁরা বাজারও পেয়েছিলেন। সবাই ক্ষুদ্র কৃষক। ছোট ছোট জমির মালিক। কিন্তু মিলিতভাবে চেষ্টা করে তাঁরা বড় সাফল্য পেয়েছেন। আব্দুল কালামজি তাঁদের সাফল্যে খুশি হয়ে তাঁদেরকে নিয়ে লিখেছিলেন। সেজন্য আমি বলি, আমাদের নতুন প্রচেষ্টার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের দেশে আগে প্রচুর ডাল আমদানি করতে হত। আমরা ২০১৪-য় সরকারে এসে কৃষকদের প্রচুর ডাল উৎপাদনের জন্য অনুরোধ করি। আর তাঁরা আমার আবেদনে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যেই দেশকে ডালের সমস্যা থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁরা বাজারও পেয়েছেন। আর আমি দেখছি যে আজকাল অনলাইন-অফলাইন ই-ন্যামের মাধ্যমেও গ্রামের কৃষকরা তাঁদের ফসল বিক্রি করছেন। আমরা ‘কিষাণ রেল’ নামক একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করেছি। করোনার সঙ্কটকালে চালু করা এই ‘কিষাণ রেল’ এবং ‘কিষাণ উড়ান’ এর মাধ্যমে ছোট কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বড় বাজারগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করেছি। এই ‘কিষাণ রেল’ ট্রেনগুলি প্রত্যেকটি চলমান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণাগার। আর আমি এই সভার সদস্যদের বলতে চাই, ‘কিষাণ রেল’ একটি এমন পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা যা ছোট কৃষকদের অনেক প্রান্তিক গ্রাম থেকে অন্য রাজ্যের বড় বাজারগুলির সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। এখন দেখুন, নাসিকের কৃষকরা মুজফফরনগরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর কী পাঠিয়েছেন? ৩০ কেজি আতা ফল। ‘কিষাণ রেল’ এর মাধ্যমে এই ৩০ কেজি পাঠাতে তাঁর কত খরচ হয়েছে? ১২৪ টাকা। অথচ সে অনেক বেশি দাম পেয়েছে। এই ৩০ কেজি ফসল এত ছোট যে অনেক ক্যুরিয়ারওয়ালাও তা নিয়ে যেতে রাজি হত না। কিন্তু এই ‘কিষাণ রেল’ চালু হওয়ায় তিনি এভাবে বিক্রি করে লাভবান হতে পেরেছেন। এভাবে এই পরিষেবা চালু হওয়ায় কেউ ‘কিষাণ রেল’ এর মাধ্যমে ডিম পাঠাচ্ছেন। একজন কৃষক দেউলালি থেকে ৬০ কেজি কিউয়ি দানাপুরে পাঠিয়েছেন। পাঠাতে তাঁর খরচ হয়েছে ৬২ টাকা এবং তিনি ভালো বাজার পেয়েছেন। তার মানে বুঝতে পারছেন কিষাণ রেল কৃষকদের জীবনে কত বড় পরিবর্তন আনার ক্ষমতা রাখে?
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
চৌধরি চরণ সিং-জি একটি বই লিখেছেন ‘ভারত কি অর্থনীতি’। এই বইয়ে চৌধরি সাহেব পরামর্শ দিয়েছেন, “খাদ্যান্ন জোগাতে সারা দেশকে একটি ক্ষেত্র বলে মানা উচিৎ”। তার মানে, দেশের এক ভাগ থেকে অন্য ভাগে যেতে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে যেন কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় তা দেখতে হবে। আমাদের সমস্ত কৃষি সংস্কার, কিষাণ রেল, মান্ডিগুলিতে চালু করা বৈদ্যুতিন প্লেট, ই-ন্যাম – এই সমস্ত কিছু আমাদের দেশের কৃষকদের, বিশেষ করে ছোট কৃষকদের একটি বড় সুযোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
যাঁরা এত কথা বলেন, তাঁরা এত বছর ধরে সরকার চালিয়েছেন। আমি এটা বিশ্বাস করি না যে তাঁরা কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে জানতেন না, বুঝতেন না। তাঁরা জানতেনও, বুঝতেনও। আর সেই কথাটাই আজ তাঁদেরকে আমি মনে করাতে চাইছি। তাঁরা এখন এই সভায় উপস্থিত নেই জানি। কিন্তু দেশবাসীর এটা বোঝা খুব প্রয়োজন। আমি একটা উক্তি পড়ছিঃ “কৃষকদের বেসরকারি বাজার, উপভোক্তা, কৃষক বাজার, ই-ট্রেডিং-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ফসল বিক্রির জন্য চুক্তি সম্পাদনের স্বার্থে রাজ্য এপিএমসি আইন পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল ২০০৫ সালে এবং ২০০৭ সালে সংশোধনের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। ফলে রাজ্যে যথারীতি ২৪টি বেসরকারি বাজার গড়ে উঠেছে” – উক্তিটি কার? এই এপিএমসি আইন পরিবর্তনের জন্য কে গর্ববোধ করছেন? এই ২৪টি বেসরকারি বাজার তৈরির জন্য কে গর্ব প্রকাশ করছেন? ডঃ মনমোহন সিং-জির সরকারের কৃষিমন্ত্রী শ্রদ্ধেয় শরদ পাওয়ারজি এই গর্ব প্রকাশ করেছিলেন। আর আজ একদম উলটো কথা বলছেন! সেজন্য সন্দেহ হয়, আপনারা কৃষকদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই পথ কেন বেছেছেন? দেশে মান্ডিগুলি যেমন চলছিল তেমনই তো চলছে। সিন্ডিকেটগুলির মূল্য নির্ধারণ করার ‘নেক্সাস’ সম্পর্কে যখন তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে এই ‘নেক্সাস’ ইত্যাদি সম্পর্কে কী বলার আছে, তখন শরদ পাওয়ারজি এমন জবাব দিয়েছেন যা অত্যন্ত আকর্ষক। তিনি বলেন, “কৃষকদের বাঁচানোর জন্যই তো এপিএমসি সংস্কারকে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে, যাতে কৃষকরা এপিএমসি মান্ডিগুলির বিকল্প পান। যখন বেশি সংখ্যক ব্যবসায়ী নথিভুক্ত হবেন, তখন প্রতিযোগিতা বাড়বে, আর এভাবেই মান্ডিগুলিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমবে”। একথা তিনি বলেছিলেন। আর সেজন্য আমি মনে করি আমাদের এই কথাগুলি বুঝতে হবে। যেখানে তাঁদের সরকার আছে, আলাদা আলাদা যাঁরা সামনে বসে আছেন, তাঁরা নিজেদের মতো করে কম-বেশি এই কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের চেষ্টা করেছেন। আর আমরা তো সেই সরকার চালাচ্ছি যারা ১,৫০০টি আইন বাতিল করেছে। আমরা প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা নেতিবাচক রাজনীতিতে যেতে চাই না। ভোজপুরি-তে একটি প্রবাদ আছে – “না খেলব, না খেলন দেব, খেলভি বিগারত” অর্থাৎ, খেলবও না খেলতেও দেব না, খেলাটাকেই নষ্ট করে দেব।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
দেশের সামর্থ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী আর কচ্ছ থেকে কামাক্ষ্যা - সবাইকে মিলিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। প্রত্যেক ভারতবাসী ঘাম ঝরালে তবেই দেশ এগোবে। আমি কংগ্রেসের বন্ধুদের মনে করাতে চাই যে দেশের জন্য পাবলিক সেক্টর যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই প্রাইভেট সেক্টরের অংশীদারিত্বও ততাটাই প্রয়োজনীয়। সরকার মোবাইল ফোন উৎপাদনকে উৎসাহ দিয়েছে, বেসরকারি কোম্পানিগুলি এসেছে। আর দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম পরিবারের হাতে স্মার্ট ফোন পৌঁছে গেছে। টেলিকমের প্রতিযোগিতাকে উৎসাহ জোগানো হয়েছে। তারপর মোবাইলে কথা বলার খরচ প্রায় হয়ে গেছে। আর ডেটার ক্ষেত্রে আজ বিশ্বে সব থেকে সস্তা ডেটা ভারতে পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের ঔষধ উৎপাদন শিল্প, আমাদের টিকা উৎপাদন শিল্প – এরা সবাই কি সরকারি? আজ ভারত যেভাবে বিশ্ব মানবতার সেবায় লাগছে, সেক্ষেত্রে আমাদের বেসরকারি ক্ষেত্রের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দেশের নবীন প্রজন্মের ওপর ভরসা রাখতে হবে। এভাবে যদি পরস্পরের দিকে কাদা ছুঁড়ি, নিজেদেরকে নিচু দেখাতে থাকি, তাহলে আমরা যে কোনও বেসরকারি গতিবিধিকে নস্যাৎ করে দেব। আমাদের আবার এসব কোন সময় হবে, কোন সরকার করবে সেজন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে।
আজ বিশ্ব বদলে গেছে। সমাজের নিজস্ব শক্তি রয়েছে, দেশের শক্তি রয়েছে। প্রত্যেকের সুযোগ পাওয়া উচিৎ। সেজন্য কাউকে বেইমান ঘোষণা করা, তাদের প্রতি নোংরা ভাষা ব্যবহার করা, এই সংস্কৃতি কোনও সময় ভোট পাওয়ার জন্য হয়তো কাজে লেগেছে। দয়া করে আমার লালকেল্লার থেকে বলা বক্তব্যটি শুনবেন। সেখানে আমি বলেছি, সম্পদ সৃষ্টিকারীরাও দেশের জন্য প্রয়োজনীয় হয়। সম্পদ সৃষ্টি হলে তবেই তো সম্পদ বিতরণ করা সম্ভব। গরীবদেরকে যদি সম্পদ বিতরণ করতে চাই তাহলে কোথা থেকে বিতরণ করব, তাঁদেরকে কিভাবে কর্মসংস্থান জোগাব? আর সবকিছু কি বাবুরা করবেন? আইএএস অফিসাররা কি সার কারখানা চালাবেন, রাসায়নিক কারখানা চালাবেন, উড়ো জাহাজ চালাবেন? এগুলি কি আজব ভাবনা নয়? বাবুদের হাতে দেশকে তুলে দিয়ে আমরা কী করতে চাইছি? আমাদের বাবুরা যেমন দেশের মানুষ, তেমনই নবীন প্রজন্মও দেশেরই মানুষ। আমরা দেশের নবীন প্রজন্মকে যত বেশি সুযোগ দেব, আমার মনে হয় ততই দেশের কল্যাণ হবে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
যখন তথ্যের ভিত্তিতে কোনও বক্তব্য টেকে না, তখন কী হয় সেটা আমরা এখন দেখেছি। আশঙ্কার গুজব রটানো হয়। এটা হবে, ওটা হবে। আন্দোলনজীবীরা এই ধরনের আবহ গড়ে তোলে। মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়, কৃষক আন্দোলনের পবিত্রতা, আর আমি অনেক দায়িত্ব নিয়ে এই ‘পবিত্রতা’ শব্দটি প্রয়োগ করছি। আমি এই কৃষক আন্দোলনকে ‘পবিত্র’ বলে মনে করি। আর ভারতের গণতন্ত্রে আন্দোলনের গুরুত্ব রয়েছে, গুরুত্ব থাকবে, আর এটা প্রয়োজনও। কিন্তু যখন আন্দোলনজীবীরা কোনও পবিত্র আন্দোলনকে নিজেদের লাভের জন্য নষ্ট করতে বেরিয়ে পড়েন তখন কী হয়?
কেউ আমাকে বলুন, এই তিনটি কৃষক আইনের প্রসঙ্গে যে আন্দোলন তার সঙ্গে যে দাঙ্গাবাজেরা কারান্তরালে রয়েছে, যে সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসবাদী বা নকশালরা লোকেরা জেলে রয়েছে তাদের ফটো নিয়ে তাদের মুক্তির দাবি জানানোর কি মানে? এসব কি কৃষক আন্দোলনকে অপবিত্র করার প্রচেষ্টা নয়?
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এ দেশে টোল প্লাজা কেন্দ্রীয় সরকার এবং সমস্ত রাজ্য সরকারের স্বীকৃত একটি ব্যবস্থা। সেই টোল প্লাজাকে ভেঙে ফেলা, সেই টোল প্লাজা দখল করা, টোল প্লাজা চলতে না দেওয়া, আর যত বিশৃঙ্খলা চলছে এসব কি পবিত্র আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার প্রচেষ্টা নয়? যখন পাঞ্জাবের মাটিতে শত শত টেলিকম টাওয়ার ভেঙে দেওয়া হয় তার কি কৃষকদের দাবির সঙ্গে কোনও সঙ্গতি রয়েছে? কৃষকদের পবিত্র আন্দোলনকে নষ্ট করার কাজ আন্দোলনকারীরা করছেন না, আন্দোলনজীবীরা করছেন। আর সেজন্য দেশবাসীর আন্দোলনকারী ও আন্দোলনজীবীদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন। আর দেশকে এই আন্দোলনজীবীদের হাত থেকে বাঁচানোও ততটাই প্রয়োজন। গুজব ছড়ানো, মানুষকে বিভ্রান্ত করা, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে দাবিয়ে রাখে। এই দেশ অনেক বড়। দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এইসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। দেশে একটা বড় অংশ রয়েছে যাঁরা সব সময় সঠিক কথা বলেন। সঠিক কথা বলা কোনও অন্যায় নয়। কিন্তু আমি অবাক হই যখন এই ধরনের মানুষেরা যাঁরা সব সময় সঠিক কাজ করেন, তাঁদেরকেও পছন্দ করেন না।
এই পার্থক্যটা বুঝতে হবে। সঠিক কথা বলেন যে মানুষেরা তাঁরা যখন সঠিক কাজ যাঁরা করেন তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন মনে হয় যে তাঁরা শুধু বলাতেই বিশ্বাস রাখেন, ভালো কিছু করায় ভরসা রাখেন না। যাঁরা ‘ইলেক্টোরাল রিফর্ম’-এর কথা বলেন, তাঁরাই ‘এক জাতি এক নির্বাচন’-এর প্রস্তাব এলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁরা উঁচু আওয়াজে কথা বলেন, কিন্তু যখন তিন তালাক রদ করার প্রসঙ্গ আসে তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। তাঁরা পরিবেশ রক্ষার কথা বলেন, কিন্তু যখন হাইড্রো পাওয়ার কিংবা নিউক্লিয়ার পাওয়ার উৎপাদনের প্রচেষ্টা করা হয়, সেখানে পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তামিলনাড়ু এর ভুক্তভোগী। এরকম হওয়া উচিৎ নয়। আন্দোলন দেশের ভালোর জন্য করুন। দিল্লিতে পরিবেশ দূষণ নিয়ে যাঁরা কোর্টে গিয়ে আবেদন করেন, জনস্বার্থ মামলা করেন, দিল্লির সেই মানুষেরাই ফসলের অবশিষ্ট জ্বালিয়ে পরিবেশ দূষণ করা মানুষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলে তাঁদের সমর্থনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তখন বুঝতে পারি না, ওঁরা দেশকে কিভাবে বিভ্রান্ত করতে চান। এটা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে এই ছয় বছরে বিরোধী দলের বক্তব্যের বিষয় কত বদলে গেছে। আমরাও কখনও বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু আমরা উন্নয়ন, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে শাসকদের বিরুদ্ধে বলতাম। আমি অবাক হচ্ছি, আজকাল বিরোধী দল কোনও উন্নয়ন নিয়ে কথা বলে না। আমি অপেক্ষা করতে থাকি যে তাঁরা এরকম কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলুন যাতে আমরা কিছু করার সুযোগ পাই। কিন্তু তাঁরা কখনও এরকম সুযোগই দেন না। সেজন্য অবাক হয়ে ভাবি, তাঁরা কেমন বিরোধীপক্ষ, যাঁরা কতটা সড়কপথ তৈরি হয়েছে, কতগুলি সেতু তৈরি হয়েছে, কতটা সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, কত কিলোমিটার রেল লাইন পাতা হয়েছে – সেসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন না! এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনায় তাঁদের কোনও আগ্রহই নেই!
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
একবিংশ শতাব্দীতে উন্নত পরিকাঠামোর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। ভারতকে এগিয়ে যেতে হলে পরিকাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব দিতেই হবে। আত্মনির্ভর ভারতের রোড ম্যাপের জন্য পরিকাঠামো নির্মাণ একটি সময়ের চাহিদা। এটা আমাদের সবাইকে স্বীকার করে নিতে হবে। পরিকাঠামো শক্তিশালী হলেই দেশের গতি বাড়বে। পরিকাঠামোর মানে হল গরীব, মধ্যবিত্তদের জন্য অনেক নতুন সম্ভাবনা, নতুন সুযোগ, নতুন কর্মসংস্থান। পরিকাঠামো অর্থনীতিকে গুণীতক হারে বৃদ্ধির শক্তি রাখে। পরিকাঠামোর মানে ভোট ব্যাঙ্কের জন্য কাজ করা নয়, কাগজে সড়ক তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন জেতা নয়। দ্বিতীয়বার গিয়ে পুরনো পথে সুড়কি ফেলে দিয়ে নির্বাচন জেতা নয়, তৃতীয়বার গিয়ে মাটি ফেলে দিয়ে নির্বাচন জেতা নয়। জনগণের জীবনে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে, অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনতে আমাদের পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা বাজেটে ১১০ লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে অভূতপূর্ব পরিকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছি। দেশের ২৭টি শহরে মেট্রো ট্রেন, ৬ লক্ষের বেশি গ্রামে দ্রুত ইন্টারনেট, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ‘এক দেশ এক গ্রিড’ – এই কাজগুলি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে আমরা সাফল্য পেয়েছি। সৌরশক্তি সহ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে আজ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি দেশের মধ্যে ভারত নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৌর এবং বায়ু – হাইব্রিড পাওয়ার আজ ভারত উৎপাদন করছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা নতুন গতি অনুভব করছি, নতুন মাত্রায় উন্নীত হচ্ছি।
আমরা দেখেছি, যেখানে যেখানে অসাম্য রয়েছে, বিশেষ করে পূর্ব ভারত। যদি পূর্ব ভারতের উন্নয়নকে পশ্চিম ভারতের সমতুল করা যায় তাহলে দেশে প্রগতির সম্ভাবনা বাড়বে। সেজন্য আমরা পূর্ব ভারতের উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছি। গ্যাস পাইপলাইন পাতা থেকে শুরু করে সড়কপথ নির্মাণ, বিমানবন্দর নির্মাণ, রেলপথ পাতা, ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা, জলপথের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিকে যুক্ত করার একটি খুব বড় প্রচেষ্টা চলছে, আর আমার মনে হয় আমাদের এই অগ্রাধিকার দেশকে একটি ভারসাম্যযুক্ত অগ্রগতির পথে নিয়ে যাবে। দেশের প্রত্যেক ক্ষেত্রকে সমভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা নিয়ে আমরা কাজ করছি। সেজন্য পূর্ব ভারতে আমরা মিশন মোডে কাজ করছি। কয়েক ডজন জেলায় সিএনজি, পিএনজি, সিটি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশনের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে আমরা সফল হয়েছি। গ্যাস পাইপলাইন পৌঁছনোর ফলে সার উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। যে সার কারখানাগুলি বন্ধ ছিল, সেগুলি খোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
অনেক বছর ধরে আমরা শুনছি ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর। কিন্তু এই ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডর কী অবস্থায় ছিল? যখন আমরা দায়িত্ব পাই, ততদিন পর্যন্ত মাত্র ১ কিলোমিটার কাজ হয়েছিল। বিগত ছয় বছরে আজ প্রায় ৬০০ কিলোমিটার কাজ হয়েছে। আর বাস্তবে সেই ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরে মালগাড়ি চলতে শুরু করে দিয়েছে। ইউপিএ-র সময়ে সীমান্ত পরিকাঠামো কী অবস্থায় ছিল! যে কোনও দেশের নিরাপত্তার জন্য সীমান্ত পরিকাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেগুলির প্রতি পূর্ববর্তী সরকার এত উদাসীন ছিল, এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে দেশবাসীর সামনে আলোচনা করতে পারি না, কারণ সেটা নিরাপত্তার দৃষ্টিতে ঠিক নয়, কিন্তু এটা চিন্তার বিষয়। উদাসীনতা কেন ছিল? কারণ সেখানে জনগণ নেই, ভোট নেই, ফৌজিরা যখন যাবেন দেখা যাবে, না করলে কী হবে? এই ভাবনার পরিণাম ছিল এই উদাসীনতা ও অবহেলা। শুধু তাই নয়, একজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তো সংসদেই বলে দিয়েছিলেন, আমরা সীমান্তে বেশি পরিকাঠামো তৈরি করতে চাই না, তাহলে শত্রু দেশ সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারে। আশ্চর্য কথা ভাই! আমরা এই ভাবনা পরিবর্তন করে আজ যতটা প্রত্যাশা করেছিলাম তার থেকে বেশি সীমান্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে পেরেছি। লাইন অফ অ্যাকচ্যুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)-এ প্রায় ৭৫টি সেতু তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। আমরা কয়েকশ’ কিলোমিটার সীমান্তবর্তী সড়কপথ তৈরি করেছি। যতটা লক্ষ্য আমরা রেখেছিলাম তার ৭৫ শতাংশ আমরা ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত করতে পেরেছি। বাকি ২৫ শতাংশের কাজ চলছে। পরিকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে এভাবেই আপনারা দেখবেন হিমাচল প্রদেশের অটল টানেলের কথা। অটলজির সময় যে সুড়ঙ্গপথের কল্পনা করা হয়েছিল, তাঁর সরকারের পরিবর্তনের পর এই পরিকল্পনার ফাইল চাপা পড়েছিল।
কিছুটা কাজ হয়েছিল। তারপরেই আটকে গিয়েছিল। বিগত ছয় বছরে আমরা পেছনে পড়ে এই অটল সুড়ঙ্গের কাজ অনেকটাই সম্পন্ন করেছি। আজ দেশের ফৌজি কনভয়গুলি সেখান দিয়ে অনেক সহজে ও দ্রুতগতিতে যেতে পারছে। দেশের সাধারণ নাগরিকও সেখান দিয়ে যাচ্ছেন। যে পথ বছরে ছয় মাস বন্ধ থাকে, এই সুড়ঙ্গ চালু হওয়ার ফলে সেই পথ এখন সারা বছর খোলা থাকছে। তেমনই আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যখনই দেশের সামনে কোনও সমস্যা আসে, এ দেশের সামর্থ্য, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলির সামর্থ্যকে কখনও ছোট করে দেখা উচিৎ নয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সেনাদলগুলির মনোবল ভেঙে যায়। আমরা এটা কখনও হতে দেব না। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আজ তাঁদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেখানেই দেওয়া হোক না কেন, অতি-প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁরা পরাক্রমের সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেন। আমরা দেশের সেনাবাহিনী নিয়ে গর্বিত, আমাদের বীরেদের নিয়ে গর্বিত। তাদের সামর্থ্য, তাদের হিম্মত, আমাদেরকে সব সময় নিরাপদ রাখে। আমি কখনও একটি গজল শুনেছিলাম। এমনিতে আমি খুব একটা গজল শুনি না। আমি গাইতেও পারিও না। কিন্তু সেখানে লেখা ছিল –
“আমি যা দিয়ে শরীর ঢাকি, যা পেতে শুই …”
শুনুন! গজলটা আমি শোনাচ্ছি –
“আমার মনে হয় এই যে সাথীরা চলে গেছে, তাঁরা যা নিয়ে বাঁচেন
প্রতিপালিত হন, তাই তাঁরা শোনাতে থাকেন
যা তাঁদের সময়ে তাঁরা দেখেছেন, যা তাঁদের সময়ে তাঁরা করেছেন
তাই তাঁরা বলতে থাকেন, আর সেজন্য মনে হয় আমাদের এখন এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের অনেক হিম্মত করে এগিয়ে যেতে হবে”
আমার মনে হয়, করোনা-উত্তর একটি নতুন বিশ্বের বিন্যাস যখন আমাদের সামনে আসছে তখন ভারতকে ‘কিছু বদলাবে না’ এই মানসিকতা ছাড়তে হবে। ‘চলছে, চলবে’ মানসিকতা ছাড়তে হবে। ১৩০ কোটি দেশবাসীর সামর্থ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। যদি ১০ লক্ষ সমস্যা থাকে তার ১০ কোটি সমাধানও আছে। এই দেশ শক্তিশালী। সেজন্য আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যেতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমরা এই ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারব। একথা সত্যি যে দেশে দালাল সংস্কৃতি শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু দেশের মধ্যবিত্তদের ভালোর জন্য দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চলেছেন। আর সেজন্য যত আইনি পরিবর্তন প্রয়োজন, সেই পরিবর্তন আমরা করছি।
মাননীয় অধ্যক্ষ মহোদয়,
এক প্রকার বিশ্বাসের সঙ্গে, একটি উন্নয়নের আবহে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে। আমি রাষ্ট্রপতিজির বক্তব্যের জন্য হৃদয় থেকে কৃতজ্ঞ কারণ তিনি অনেক বিষয় স্পষ্ট করে বলেছেন। যাঁরা রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেন, তাঁদেরকে শুভেচ্ছা জানাই। কিন্তু আমরা দেশের কল্যাণের এজেন্ডা নিয়ে চলি। আমরা দেশের কল্যাণের এজেন্ডা নিয়েই এগিয়ে যাব। আমি আরেকবার দেশের কৃষকদের অনুরোধ জানাই, আসুন, টেবিলে বসে সবাই মিলে সমস্যাগুলি সমাধান করি। এই কামনা নিয়ে রাষ্ট্রপতিজির ভাষণের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি নিজের বক্তব্যকে বিরাম দিচ্ছি।
অনেক অনেক ধন্যবাদ!
***
CG/SB/DM
(Release ID: 1698231)
Visitor Counter : 447
Read this release in:
English
,
Urdu
,
Hindi
,
Marathi
,
Manipuri
,
Assamese
,
Punjabi
,
Gujarati
,
Odia
,
Tamil
,
Telugu
,
Kannada
,
Malayalam