• Skip to Content
  • Sitemap
  • Advance Search
Others

নাগরিকত্ব সংশোধন বিল কেন প্রয়োজনীয়

Posted On: 13 DEC 2019 2:38PM
  • শান্তনু মুখার্জী

 

 

অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জী রূপায়ণ প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আসলে, নাগরিকপঞ্জীর উদ্দেশ্য হল - আসামে অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ সরকারের অন্যান্য বরিষ্ঠ মন্ত্রীরা বার বার একথা বলে আশ্বাস দিয়েছেন যে, দেশের কোনও প্রকৃত নাগরিকই চূড়ান্ত জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়বেন না।

এখন নাগরিকত্ব বিল নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। সমালোচকদের বক্তব্য এনআরসি যদি অসমের পরম্পরাগত ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষের সুরক্ষা ও চিহ্নিতকরণের বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল হ’ল ধর্মীয় সুরক্ষা কবচ দেওয়া। এদের আরও অভিমত যে, এনআরসি-র মধ্য দিয়ে বিভাজনের নীতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় নাগরিকপঞ্জী অসমের ভূমিপুত্রদের স্বার্থেরও পরিপন্হী।

অবশ্য, নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিভিন্ন ধারা খতিয়ে দেখলে এটা স্পষ্ট হবে যে এই বিলের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।

এই বিলে কেবল হিন্দুদের নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব দানের কথাও। এমনকি, এই বিলে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দানের কথাও বলা হয়েছে, যাঁরা ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে এই সমস্ত মানুষজন অন্য কোন বিকল্প না খুঁজে পেয়ে বাধ্য হয়েই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হন।

ইতিমধ্যেই, নাগরিকত্ব সংশোধন বিল বিপুল সংখ্যাধিক্যে লোকসভায় পাশ হয়েছে। এই বিলে উক্ত তিনটি দেশ থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে এদেশে চলে আসা ব্যক্তিদের যাঁরা পাঁচ বছর ভারতে বসবাস করছেন, তাদের নাগরিকত্ব দানের কথা বলা হয়েছে। নাগরিকত্ব দানের এই প্রস্তাবে বহু মানুষ বিরোধীতা করে বলেছেন যে ভারত সরকার নির্দিষ্ট কয়েকটি ধর্মের মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন। তবে একথাও মনে রাখতে হবেযে, ঐ তিনটি দেশে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন,পার্সি ও খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর যে ধর্মীয় নির্যাতন হয়েছে, তা আজ আর গোপন নেই।

প্রকৃতপক্ষে এই তিন দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বিরুদ্ধাচারণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের সংবিধানের অন্যতম নীতির অঙ্গ। এই দেশগুলির সংবিধানে ইসলামকেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম বলে গণ্য করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গী বজায় রয়েছে। এমনকি, এই দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সংবিধানের রক্ষাকবচও পেয়েছে। অনন্তকাল ধরে আমরা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকারব্যক্তি দেরশরণার্থীর মর্যাদা দিয়েছি, ইতিহাসতার সাক্ষী রয়েছে। দ্বাদশশতাব্দীতে ইরান থেকে জরাথ্রুষ্টধর্মাবলম্বী মানুষ বা গৃহযুদ্ধের কারণের শ্রীলঙ্কা থেকে পালিয়ে আসা তামিল মানুষজন, পাকিস্তান থেকে সুনামনষ্টের ভয়ে চলে আসা হিন্দুরা, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত যুদ্ধ ও হিংসার দরুণ চলে আসা মানুষ অথবা তিব্বত থেকে বিতাড়িত হওয়া মানুষ ভারতে এসে শান্তি ও সমৃদ্ধিলাভ করেছেন। আমাদের দেশ সর্বদাই খোলা মনে দু’হাত বাড়িয়ে শরণার্থী এই সমস্ত মানুষকে মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গীতে সাদরে গ্রহণ করে তাঁদের বসবাসের জায়গা করে দিয়েছে।

একথা মনে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজনযে, ঐ তিন দেশ থেকে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে এক প্রকার তাড়িয়ে দেওয়া শরণার্থী মানুষ এদেশে বসবাসের সুযোগ পাবার ফলে তাঁরা সকলেই যে ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন, তার কোনও নিশ্চয়তানেই। শরণার্থী হিসাবে বসবাসকারী এই সব মানুষজনকে ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতেহবে। এমনকি, নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য তাঁদের আবেদনগুলি খতিয়ে দেখা হবে। এদের সকলকেই যে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে – তেমন কোনও প্রস্তাব বিলে নেই।

সংশোধিত নাগরিকত্ব বিলের সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধাভোগীদের ব্যাপারে একথাও মনে রাখা প্রয়োজনযে, এই দেশগুলি থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতির দরুণএদের ভারতে চলে আসতে বাধ্য হতে হয়েছে কেবল আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগের জন্য নয়। এরাকেউ-ই আর্থিক সুবিধা ভোগীশরণার্থী নন, এই আশা নিয়ে ভারতে এসেছে নযে, তাঁদের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন ঘটবে এবং ভারতের বিরাট আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। শরাণার্থী এই সমস্ত মানুষ বিভিন্ন দিক থেকে নিপীড়ন ও বর্বরতার শিকার।

সংখ্যালঘু শরণার্থীদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের সংগ্রামরোহিঙ্গাদের মতো অনুপ্রবেশকারীদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে একথা উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি যে, মায়ানমার থেকে আসা শরণার্থী সম্পর্কে ভারতীয় গোয়েন্দা বিভাগ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে মৌলবাদের ভীতি রয়েছে, যারা বর্তমানে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে অথবা বাংলাদেশ লাগোয়া সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে প্রবেশের চেষ্টা করছে। 

আমাদের হাতে যে তথ্য রয়েছে, তাথেকে এটা স্পষ্ট যে, এ ধরনের শরণার্থী গোষ্ঠী ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার কাছে বড় বিপদ। তাই, এ ধরনের বিপদ সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করার অর্থই হ’ল – ভারতীয় নাগরিকদের সুরক্ষার সঙ্গে আপোষ করা। সুতরাং, এ ধরনের ঝুঁকি কোনও সরকার-ই নিতে পারে না।

বহু সমালোচক একথানা জেনে-বুঝেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন যে, একবার নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাশ হয়ে গেলে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বোঝা অসম রাজ্যকেই বহন করতে হবে। কিন্তু, প্রকৃত ঘটনা এটাই যে, এই বিল কোনও একটি রাজ্যের জন্য নয়, সারা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

নাগরিকত্ব সংশোধন বিলে একথা উল্লেখ নেই যে, বিল কার্যকর হলে অসম চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। এই চুক্তির ভিত্তিতেই সমগ্র এনআরসি প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে। এনআরসি-তে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখের আগে থেকে এদেশে থাকা ব্যক্তিদের যোগ্য প্রমাণের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ মিলবে।

একটিসরকার, যারা অতীতের ভুল গুলিকে সংশোধনের চেষ্টা করছে এবং প্রকৃত অসমবাসী মানুষের স্বার্থসুরক্ষায় সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে,তাদের কোনোভাবেই মানুষের স্বার্থ বিপন্নেরদায়ে অভিযুক্ত করা যায়না।

এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা বিভ্রান্তহয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের ফলে নতুন করে বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে,বিশেষকরে অসমে প্রবেশ ঘটবে। সমালোচকদের দাবি এ ধরণের ঘটনা ঘটলে এনআরসি প্রক্রিয়া এক প্রকার প্রতিহত হবে। এমনকি, এই রাজ্যের ভাষাগত ও জাতিগত ভারসাম্যও ক্ষুণ্নহবে।

অবশ্য, এটা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যায় হিন্দু শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশ ঘটেছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী,বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে ২৮ শতাংশ থেকে কমে বর্তমানে প্রায় ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আমরা যদি এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণকরি,তাহলে এটা স্পষ্ট হবে যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষই ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এমনকি,সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়ার ফলে বর্বরতার ঘটনাও লক্ষ্যণীয়ভাবে কমেছে। এ থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, ধর্মীয় নিপীড়ণের দরুণ ভারতে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীদের আগমন হয়েছে।

ভারত কোনোভাবেই তার সহ-নাগরিক ভাই-বোন, যাঁরা সরকারের পদক্ষেপের ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিজেদের আস্থাকে পেছনে ফেলে দেশভাগের বলি হয়েছেন, তাঁদের পুনরায় দেশে ফিরিয়ে আনতে। তাই, এটা আমাদের সাংবিধানিক কর্তব্য, দেশভাগের শিকার সেই সব মানুষকে ভারতে জায়গা করে দিয়ে উদার মনে স্বাগত জানানো। অতীতের ভুল শুধরে এবং মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। এই কর্তব্য ভারতের সমস্ত রাজ্যকে পালন করতে হবে এবং দেখতে হবে যাতে কেবল অসমের মানুষকেই এই বোঝা বহন করতে না হয়।

একইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। সেই সমস্ত দেশ ভারতের আশেপাশে রয়েছে, যাঁদের সংবিধানে ধর্মকেই রাষ্ট্রনীতির অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাই, আমরা চোখ বুজে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকারনয়, এমন বিদেশি নাগরিক, যারা শরণার্থী হিসাবে মর্যাদার দাবি জানাচ্ছে, তাদের ভারতে ঢুকতে দিতে পারিনা।

 

 

  • লেখক ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক।

 

 

SSS/BD/SB

(Features ID: 150582) Visitor Counter : 55
Link mygov.in
National Portal Of India
STQC Certificate