নয়াদিল্লি, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঘনিষ্ঠ সামাজিক বন্ধনের জন্য সুপরিচিত উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি রাজ্য মিজোরাম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রাজ্য এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছে। মিজোরাম দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ এইচআইভি সংক্রমণের হার নিয়ে লড়াই করছে, যেখানে আক্রান্তদের বড় অংশই তরুণ। আর এই অংশের তরুণদের প্রচলিত এইচআইভি পরীক্ষার জন্য যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হয়, এর জন্য তাদেরকে পোহাতে হয় সামাজিক স্তরে এক ধরণের সংকোচ বোধ।
এছাড়া রয়েছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া আসার জন্য যাতায়াতের সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে, এইচআইভি’র স্বেচ্ছা-পরীক্ষা (এইচ.আই.ভি.এস.টি.) একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে, যা নিশ্চিত করছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সুবিধাজনক ব্যবহার এবং কার্যকরী পরীক্ষা-নিরীক্ষার বন্দোবস্ত।


মিজোরামে দীর্ঘদিন ধরেই এইচআইভি-র সংক্রমণ জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে, সংক্রমণের প্রধান কারণ হলো অরক্ষিত যৌনসম্পর্ক ও ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এর প্রবণতা। সচেতনতার প্রচার চালানো হলেও, অনেকেই পরীক্ষা করাতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন, ফলে সংক্রমণ ধরা পড়তে দেরি হয় এবং সেজন্য সংক্রমণ গভীরে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। এই পরিস্থিতিতে, একটি নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল—যা ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ এনে দেবে, যাতে কোনো সামাজিক বাধা, লজ্জা বা যাতায়াতজনিত প্রতিবন্ধকতা না থাকে। এইচআইভি’র এই স্বেচ্ছা-পরীক্ষার ব্যবস্থা এই রাজ্যে এখন একটি গেম-চেঞ্জার বা পরিবর্তনের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছে।
এইচআইভি’র স্বেচ্ছা-পরীক্ষা এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ব্যক্তি নিজেই বাড়িতে একটি সহজ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করতে পারেন। সাধারণত, এই কিট ব্যবহার করে লালা বা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যায়। বিশ্বের অনেক দেশেই এই পদ্ধতি সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, এবং মিজোরামে এটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, পরীক্ষার ফল জানার সামাজিক স্তরে তথাকথিত কলঙ্ক দূর করতে সাহায্য করবে এবং ব্যক্তিকে সচেতনভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ করে দেবে। তাছাড়া, এটি পরীক্ষার প্রক্রিয়াকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে, যেখানে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ সীমিত।
মিজোরামের এইচআইভি স্ব-পরীক্ষার সফলতা অন্যান্য রাজ্যের জন্য একটি কার্যকরী মডেল হতে পারে। যদি যথাযথভাবে বিস্তৃত করা যায়, তবে এটি দেশে এইচআইভি প্রতিরোধ করার কৌশলকে বদলে দিতে পারে, বিশেষত সেইসব অঞ্চলে যেখানে সংক্রমণের হার বেশি এবং স্বাস্থ্যসেবা সীমিত, সেখানকার জন্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারে । এজন্য, স্থানীয় সমস্যার ওপর ভিত্তি করে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো, কলঙ্ক দূর করতে সুনির্দিষ্ট বার্তা প্রদান এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে এইচ.আই.ভি.এস.টি. সংযুক্ত করে টেলি-হেলথ পরিষেবার মাধ্যমে কাউন্সেলিং ও প্রাথমিক চিকিৎসার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণেও গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ও এনজিওদের সহযোগিতায় এর পরিধি আরও বাড়ানো যেতে পারে।
ভারত সরকার বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হল জাতীয় এইডস ও এসটিডি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এন.এ.সি.পি.) এর পঞ্চম পর্ব (ফেজ-৫), যা কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পূর্ণ অর্থ সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে এবং যার বরাদ্দ ১৫,৪৭১.৯৪ কোটি টাকা। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত জাতীয় এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচিকে বিস্তৃত করা এবং রাষ্ট্রসংঘের সুস্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এস.ডি.জি.)—৩.৩-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে এইচআইভি/এইডস মহামারিকে নির্মূল করা।


এন.এ.সি.পি.-ফেজ-৫ মূলত পূর্ববর্তী উদ্যোগগুলোর ওপর ভিত্তি করে নতুন কৌশল সংযোজন করেছে, যার মধ্যে ‘সম্পূর্ণ সুরক্ষা কেন্দ্র’ (এসএসকে) অন্যতম। এটি “একক পরিষেবা কেন্দ্র” হিসেবে কাজ করে, যেখানে এইচআইভি এবং যৌন সংক্রমিত রোগ (এসটিআই) ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় সকল পরিষেবা একসঙ্গে পেতে পারেন। এই কেন্দ্রগুলো ‘প্রিভেনশন-টেস্ট-ট্রিট-কেয়ার চক্রের’ মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করে, যাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা যায়।
এছাড়া, মিজোরাম স্টেট এইডস কন্ট্রোল সোসাইটি (এমএসএসিএস) সেরাজ্যে বিভিন্ন এইচআইভি প্রতিরোধ ও পরীক্ষামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করছে। মোবাইল টেস্টিং সেন্টার, কাউন্সেলিং এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা ছাড়াও বিশেষত কারাগারে থাকা মানুষের মধ্যে সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দফতর (ইউএনওডিসি) স্বীকৃতি দিয়েছে।
এইচআইভি’র স্বেচ্ছা-পরীক্ষা মিজোরামের এইডস মোকাবিলায় একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হয়ে উঠেছে। এটি যেমন লজ্জাবোধ ও সামাজিক বাধা দূর করতে সহায়তা করছে, তেমনি সংক্রমণ দ্রুত শনাক্ত করে ঝুঁকি হ্রাস করছে। মিজোরাম এই পথ ধরে এগিয়ে চলার ফলে, অন্যান্য রাজ্যের জন্যও এই পদ্ধতি একটি আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। সঠিক নীতি, সহযোগিতা এবং সচেতনতা প্রচারের মাধ্যমে, এইচ.আই.ভি.এস.টি. গোটা ভারতে একটি কার্যকরী কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যা ভারতের অন্যতম গুরুতর স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্র:
https://pmc.ncbi.nlm.nih.gov/articles/PMC11835815/
https://naco.gov.in/national-aids-control-programme-v
https://www.unodc.org/southasia/frontpage/2010/november/mobile-ictc-in-mizoram-prison.html
https://www.naco.gov.in/sites/default/files/NACO%20Newsletter%20April%20%20June%202023%20%28English%29.pdf
https://www.incredibleindia.gov.in/
Click here for pdf file
***
SKC/ADK/KMD